খুলনার কয়রা উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন সমুদ্র উপকূলের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চিংড়ির রেণু আহরণ ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত। নদীতে ভেসে আসা ‘সাদা সোনা’–খ্যাত বাগদা ও গলদা চিংড়ির রেণু আহরণ ও বিক্রি করে তাঁদের ভাগ্য বদলেছে। সেই সঙ্গে বদলেছে তাঁদের জীবনযাত্রাও।
কয়রা উপজেলার সুন্দরবনের গা–ঘেঁষা জোড়শিং গ্রামের বাসিন্দা আবুল হোসেন। তিনি বলেন, একসময় সুন্দরবনের কাঠ কেটে গৃহস্থের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বেচতেন। এ থেকে যা পেতেন, তা দিয়ে কোনোমতে চলত সংসার। যেদিন কাঠ কাটা বন্ধ থাকত, সেদিন উপোস থাকতে হতো। তবে এখন আর সুন্দরবনের কাঠের ওপর ভরসা করতে হয় না। নদীর পানিতে ভেসে আসা সাদা সোনায় (রেণু) তাঁদের ভাগ্য বদলেছে।
সম্প্রতি উপকূল এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, সুন্দরবনের গহিনের নদী থেকে উজানে ভেসে আসা বাগদা ও গলদার রেণু পোনা ধরার জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অসংখ্য নারী-পুরুষ নেট দিয়ে তৈরি একধরনের জাল পেতে অপেক্ষা করছেন। কেউ নৌকায় বসে মাঝনদীতে জাল পেতেছেন। কেউ আবার নদীতীরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত জাল টেনেই চলেছেন। মাঝেমধ্যে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে জালে আটকে পড়া ক্ষুদ্রাকৃতির গলদা ও বাগদা চিংড়ির রেণু পোনা নদীর চরে রাখা গামলাতে উঠিয়ে রাখছেন।
কয়রা উপজেলার কাশিরহাটখোলা ও মদিনাবাদ লঞ্চঘাট–সংলগ্ন এলাকার জেলেদের কাছ থেকে রেণু পোনা কিনে এনে তা জড়ো করেছেন ফড়িয়ারা। সেখান থেকে অন্য ফড়িয়ারা পোনা কিনে মাছের ঘেরে পৌঁছাচ্ছেন। আবার সরাসরি ঘেরমালিকেরাও রেণু কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। রেণু আহরণকারী জেলেদের থেকে ঘেরমালিকদের কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত দামের পার্থক্য হয় দুই থেকে তিন শ টাকা। আবার দূরে কোথাও রেণু পৌঁছাতে দামের তারতম্য দ্বিগুণ হয়। বর্তমানে প্রতি হাজার রেণু বিক্রি করা হচ্ছে ১ হাজার ২০০ টাকায়।
চিংড়ির রেণু ধরেই চলছে তাঁর সংসার। ছোটবেলা থেকেই বাগদা ও গলদা চিংড়ির রেণু ধরেন তিনি।আবদুর রহমান, কপোতাক্ষ নদের তীরের বাসিন্দা
জেলেদের ভাষ্য, বছরের অধিকাংশ সময় বাগদার রেণু পাওয়া গেলেও চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ—এই তিন মাস গলদার রেণু পাওয়া যায় উপকূলের নদীতে। এই তিন মাস জেলেদের জন্য বিশেষ সময়। কারণ, বাগদার রেণুর তুলনায় গলদার রেণুর দাম অনেক বেশি। এ জন্য গলদার রেণু ধরার মৌসুমের জন্য জেলেরা অপেক্ষায় থাকেন।
কয়রার কপোতাক্ষ নদের তীরের গাজীপাড়া গ্রামের আবদুর রহমান বলেন, চিংড়ির রেণু ধরেই চলছে তাঁর সংসার। ছোটবেলা থেকেই বাগদা ও গলদা চিংড়ির রেণু ধরেন তিনি। এখন বাগদার রেণু ধরছেন। এসব ধরে প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় হয়। শুধু তিনি নন, কপোতাক্ষ নদের তীরে এমন হাজারো মানুষ চিংড়ির রেণু ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তিনি আরও বলেন, এগুলো বিক্রি করতে বাইরে কোথাও যেতে হয় না। ফড়িয়ারা এখান থেকেই কিনে নিয়ে যান। পরে তাঁরা বিভিন্ন আড়ত ও ঘের ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেন।
কয়রার উপকূল এলাকার ৩০টি গ্রামের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ চিংড়ির রেণু আহরণ ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর ৬০ শতাংশ পরিবার রেণু ধরা ও ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর নির্ভরশীল।
সম্প্রতি সুন্দরবনসংলগ্ন কাটকাটা গ্রামে গিয়ে শাকবাড়িয়া নদীতে অনেক নারী-পুরুষকে পিঠে দড়ি বেঁধে জাল টানতে দেখা যায়। সেখানে জাল নিয়ে নদীতে নামছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা সুষমা রানী মণ্ডল। আলাপকালে তিনি বলেন, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাছ ধরে যা আয় হয়, তাতেই চলে তাঁর সংসার। নদী থেকে ধরা চিংড়ির রেণুগুলো খুব ভালো হয়। বড় ঘের ব্যবসায়ীরা সব কিনে নিয়ে যান।
সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার পেশাজীবীদের নিয়ে কাজ করে বেসরকারি সংস্থা প্রতিবেশ অ্যাকটিভিটিজ। সংস্থাটির প্রকল্প সমন্বয়ক মো. আলাউদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে কয়রার উপকূল এলাকার ৩০টি গ্রামের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ চিংড়ির রেণু আহরণ ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোর ৬০ শতাংশ পরিবার রেণু ধরা ও ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর নির্ভরশীল। এর ফলে সুন্দরবনের ওপর চাপ কমেছে। অভাব-অনটনের এ জনপদের মানুষের সচ্ছলতা ফিরে আসার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এসব চিংড়ির রেণু। ১০ বছর আগের তুলনায় এই জনপদ এখন অনেক সমৃদ্ধ।
কয়রা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আমিনুল হক বলেন, যাঁরা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন, এমন ১৩ হাজার ৫২৬ জন জেলেকে মৎস্যজীবী কার্ড দেওয়া হয়েছে। তবে সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকার নদ-নদীতে এভাবে অপরিকল্পিত পন্থায় মাছের পোনা আহরণকে মৎস্য সম্পদের জন্য অনেকটা হুমকি হিসেবে দেখছেন তিনি। কারণ হিসেবে মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, অনভিজ্ঞ জেলেরা বাগদা ও গলদার পোনা আহরণের সময় অন্য প্রজাতির মাছের পোনাও নষ্ট করে ফেলেন। এ জন্য জেলেদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার।