এত দিন ছোট বিদ্যালয়টিতে বাংলা মাধ্যমেই শিশুরা প্রাথমিকের পড়ালেখা শিখেছে। একটু বড় হলে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে শহরের কোনো বিদ্যালয়ে। নয়তো দূর অন্য কোথাও। সবখানে একই মাধ্যম—বাংলা। এতে শিশুদের মাতৃভাষাচর্চার আর সুযোগ থাকছে না। খাসি (খাসিয়া) জাতিগোষ্ঠীর এই শিক্ষার্থীদের অনেকেই আছে, যারা মাতৃভাষায় পড়ালেখা তো পারেই না, কথা বলতেও ভুলে যাচ্ছে।
খাসি ভাষার বিলুপ্তি ঠেকাতে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার আশিদ্রোন ইউনিয়নের হোসনাবাদ খাসিয়া পানপুঞ্জিতে (ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর গ্রাম) চালু করা হয়েছে মাতৃভাষার স্কুল। বাংলা মাধ্যমের ক্লাস শেষে পুঞ্জি কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে একই স্কুলে খাসি ভাষার চর্চার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
পানপুঞ্জি ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ভারত সীমান্তঘেঁষা একটি পাহাড়ি আদিবাসী গ্রাম হোসনাবাদ। শ্রীমঙ্গল উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে গ্রামটির অবস্থান। এই গ্রামে ২৭টি খাসি (খাসিয়া) পরিবারের প্রায় ২০০ মানুষের বসবাস। তাঁদের প্রধান পেশা খাসিয়া পান চাষ। গ্রাম থেকে দেড়-দুই কিলোমিটার দূরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। পাহাড়ি পথে শিশুদের অতটা পথ মাড়ানো বেশ কঠিন। উচ্চবিদ্যালয় আরও দূরে। আড়াই-তিন কিলোমিটার হবে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি সংস্থা কারিতাসের উদ্যোগে প্রায় ১০ বছর আগে হোসনাবাদ পুঞ্জিতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় চালু হয়েছে। এটি বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়। সকাল ১০টায় এই বিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হয়। চলে বেলা একটা পর্যন্ত। পুঞ্জির কিছু অভিভাবক তাঁদের সন্তানদের শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে হোস্টেলে রেখে পড়ান। এই শিক্ষার্থীরাও বাংলা মাধ্যমে পড়ালেখা করে। যত দিন যাচ্ছে, অভিভাবকসহ পুঞ্জির লোকজন টের পাচ্ছিলেন খাসি ভাষাটি দ্রুত তাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অনেকে খাসি ভাষায় পড়ালেখা তো পারেই না। কথা বলতেও পারছে না। বুঝতে পারে না খাসি ভাষার অনেক শব্দের অর্থও। ভাষাটা ক্রমশ বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
বিষয়টি অনেককেই ভাবনায় ফেলে দেয়। কিন্তু কীভাবে মাতৃভাষার রক্ষা ও চর্চা হবে; তা নিয়ে তাঁদের সামনে কোনো দিকনির্দেশনা ছিল না। বছর দুই আগে শ্রীমঙ্গলের তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নজরুল ইসলাম খাসি ভাষার কিছু বই সংগ্রহ করে পানপুঞ্জিগুলোতে সরবরাহ করেন। এরপরই হোসনাবাদ পুঞ্জির মান্ত্রীসহ (পুঞ্জিপ্রধান) অন্যরা চেষ্টা করছিলেন কীভাবে ভাষার চর্চাটা শুরু করা যায়। এর অংশ হিসেবে হোসনাবাদ পুঞ্জি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে ভিত্তি করে গত বছরের নভেম্বর মাসে শুরু করা হয় ভাষার স্কুল।
বাংলা মাধ্যমের স্কুলটিতে বেলা দুইটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত শুধু খাসি ভাষায় পাঠদান করা হচ্ছে। পুঞ্জির পক্ষ থেকে গ্লোরিয়া সুমের নামে একজনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁকে কিছু পারিশ্রমিক দেওয়া হয় পুঞ্জির পক্ষ থেকে। শিক্ষার্থী আছে ২৫ জন। গ্লোরিয়া সুমের বাংলা বলতে পারেন না। তিনি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলংয়ে পড়াশোনা করেছেন। খাসি ভাষায় গ্লোরিয়া সুমেরের দক্ষতা শিশুদের মাতৃভাষা শেখার ক্ষেত্রে খুব কাজে লাগছে।
হোসনাবাদ পানপুঞ্জির একজন অভিভাবক জেনেভা লামিন গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে ভাষার স্কুলটা দেওয়ায় আমাদের খুব লাভ অইছে। সবাই মাতৃভাষা ভুলে যাইতেছে। আমার চার ছেলেমেয়ের মধ্যে দুইটা ছেলে ও একটা মেয়ে এই স্কুলে পড়ছে। একটা ছেলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে শ্রীমঙ্গলে। সে খাসিয়া (খাসি) ভাষা পড়তে-লিখেতে তো পারেই না, বলতেও পারে না।’
হোসনাবাদ পুঞ্জির মান্ত্রী (পুঞ্জিপ্রধান) ক্রিন পতাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘খাসি মাতৃভাষার স্কুলটা তিন-চার মাস হয়েছে শুরু করছি। আগের স্কুলটা (বাংলা মাধ্যম) কারিতাস চালাই তো। এখনো তারা কিছু সহযোগিতা করে। কিন্তু এটা (ভাষার স্কুল) কাভার করে না। আমাদের তরফ থেকে (পুঞ্জি থেকে) মাতৃভাষার স্কুল আমরা চালাই। স্কুলের মাস্টাররে কিছু বেতন দিই। ইউএনও (সাবেক ইউএনও নজরুল ইসলাম) কিছু বই দিছিল। এটা দিয়া স্কুল শুরু করছি।’
বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে খাসি সোশ্যাল কাউন্সিলের তথ্য ও প্রচারবিষয়ক সম্পাদক সাজু মারছিয়াং গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, খাসি মাতৃভাষাকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের এগিয়ে আসা দরকার। নতুবা খাসি শিশুরা নিজস্ব মাতৃভাষা থেকে বঞ্চিত হবে। একসময় দেখা যাবে এ ভাষায় কথা বলার জন্য কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এভাবে ভাষাটি হারিয়ে যাবে।