চিকিৎসক-সংকটে সেবা ব্যাহত 

এখানে পাঁচ বছর ধরে শিশুবিশেষজ্ঞ নেই। সার্জারি বিশেষজ্ঞ পদ শূন্য থাকায় অস্ত্রোপচার করা হয় ধার করা চিকিৎসক দিয়ে।

রাজবাড়ীর ৫০ শয্যার গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের সামনে রোগীদের ভিড়। গত ৩০ মে তোলা ছবি

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার ৫০ শয্যার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসে রোগীরা কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম না থাকায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। জ্বালানি তেলের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না দেওয়ায় অ্যাম্বুলেন্স সেবাও ব্যাহত হচ্ছে।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এবং আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তাসহ ২৫টি পদ রয়েছে। এর মধ্যে ১০টি পদ শূন্য। জুনিয়র বিশেষজ্ঞের ১০টি পদের মধ্যে সার্জারি, কার্ডিওলজি, শিশু, চক্ষু, চর্ম ও যৌনরোগ এবং নাক, কান, গলাসহ (ইএনটি) ছয়টি পদ শূন্য রয়েছে। এ ছাড়া এখানে জরুরি বিভাগের চিকিৎসা কর্মকর্তাসহ (ইএমও), ডেন্টাল সার্জন, চিকিৎসা কর্মকর্তাসহ চারটি পদ শূন্য। ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে এখানে শিশুবিশেষজ্ঞ নেই। এখানে এখানে জুনিয়র বিশেষজ্ঞ গাইনি, মেডিসিন, অর্থোপেডিকস ও অবেদনবিদ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও), ছয় জন চিকিৎসা কর্মকর্তা, একজন আইএমও, একজন প্যাথলজিস্ট, এবং একজন সহকারী সার্জন কর্মরত অছেন। 

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পাশে হওয়ায় প্রায় দুর্ঘটনাসহ নানা সমস্যা নিয়ে মানুষ চিকিৎসার জন্য আসেন। অথচ গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক স্বল্পতায় কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।
মো. মোস্তফা মুন্সী, উপজেলা স্বাস্থ্য কমিটির উপদেষ্টা ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে আরও জানা যায়, নার্সিং সুপারভাইজারসহ ৪৫ জন সিনিয়র স্টাফ নার্সের মধ্যে ১ জন পুরুষসহ আছেন ৩৫ জন। ৩য় শ্রেণির কর্মচারী ৫৪ জনের মধ্যে আছেন ৩৪ জন, ২০টি পদ শূন্য। চতুর্থ শ্রেণির ২৫ জন কর্মচারীর মধ্যে আছেন ১০ জন। 

চিকিৎসা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৩১ থেকে ৫০ শয্যা হলেও প্রয়োজনমাফিক জনবল বাড়ানো হয়নি। অবেদনবিদ না থাকায় সব সময় অস্ত্রোপচার করা যায় না। জরুরি প্রয়োজনে একজন চিকিৎসক দিয়ে আপৎকালীন কাজ করানো হয়। ডিজিটাল এক্স–রে মেশিন নেই। জ্বালানি তেলের জন্য সঠিকভাবে অর্থ বরাদ্দ না দেওয়ায় চার মাস অ্যাম্বুলেন্স সেবা বন্ধ ছিল। তবে দুই সপ্তাহ আগে কিছু বরাদ্দ পাওয়ার পর অ্যাম্বুলেন্স সেবা নিয়মিত চালুর চেষ্টা চলছে।

পৌরসভার জুড়ান মোল্লাপাড়ার বাসিন্দা লিটন শেখ বলেন, কিছুদিন আগে তাঁর এক বয়স্ক নিকটাত্মীয় অসুস্থ্ হলে তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্স না পাওয়ায় বেশি টাকায় গাড়ি ভাড়া করে তাঁর আত্মীয়কে ফরিদপুর নিয়ে যেতে হয়।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে এখানে ৫০ শয্যার কার্যক্রম শুরু হয়। ওই বছরের ২৩ এপ্রিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি অত্যাধুনিক আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন বরাদ্দ দেয়। জনবলের অভাবে দীর্ঘদিন বাক্সবন্দী থাকায় অনেকটা অচল ছিল। জরুরি প্রয়োজনে আপৎকালীন চিকিৎসা কর্মকর্তা দিয়ে কাজ সামাল দেওয়া হচ্ছে। জ্বালানির অর্থসংকটে প্রায় চার মাস সাধারণ রোগী অন্যত্র পাঠানো অ্যাম্বুলেন্স সেবা বন্ধ ছিল।

সরেজমিনে একদিন

গত সোমবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত অবস্থান করে দেখা যায়, জরুরি বিভাগের সামনে রোগী ও স্বজনসহ অন্তত ২৫-৩০ জন ভিড় করে আছেন। বহির্বিভাগ টিকিট কাউন্টার ও ওষুধ কাউন্টারের সামনেও দুই শতাধিক মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। চিকিৎসকদের প্রতিটি কক্ষের সামনে নারী-পুরুষের লম্বা লাইন।

সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বহির্বিভাগের ৯ নম্বর কক্ষের সামনে নারীদের ভিড়। কে কার আগে চিকিৎসকের চেম্বারে ঢুকবেন, সেই চেষ্টা করছেন। অপেক্ষমাণ নারীদের বক্তব্য, গাইনি সমস্যায় ডাক্তার দেখাতে সকাল থেকে অপেক্ষা করছেন। গাইনিবিশেষজ্ঞ না থাকায় একজন নারী চিকিৎসা কর্মকর্তা রোগী দেখছেন। 

রাজবাড়ী সদর উপজেলার খানখানাপুর থেকে আসা রুপালী বেগম নামের এক নারী বলেন, সকাল ৮টা থেকে অপেক্ষা করছেন। সকাল ১০টার দিকে ডাক্তার এসে রোগী দেখা শুরু করেছেন। গাইনি সমস্যায় ডাক্তার দেখাতে সকাল থেকে কক্ষের সামনে তাঁর মতো দূর থেকে আসা লতা বেগম, মর্জিনা খাতুনসহ অনেকে অপেক্ষা করছেন।

হাসপাতালের বহির্বিভাগের ১ নম্বর কক্ষে শিশু রোগী দেখছিলেন উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার মো. জাকির হোসেন। তিনি বলেন, প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত রোগীর চাপ থাকে। বিশেষ করে ডায়রিয়ার রোগী বেশি আসছে।

দ্বিতীয় তলায় পুরুষ ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকটি শয্যা কাত হয়ে আছে। তাতেও রোগীরা অবস্থান করছেন। সেখানে রোগী দেখছেন আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) শরীফুল ইসলাম। রোগী দেখা শেষে বলেন, চিকিৎসক স্বল্পতার কারণে রোগীদের যথাযথ সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না। চারজন জুনিয়র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকলেও সপ্তাহে চার দিন আসেন। একজন জরুরি বিভাগে বসেন। বাকি সবাই প্রয়োজনে অন্য কক্ষে বসেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাসহ তাঁকে প্রশাসনিক কাজ, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে নানা দাপ্তরিক কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়।

আরএমও শরীফুল ইসলাম বলেন, এক সপ্তাহ ধরে কয়েকটি শয্যা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন বহির্বিভাগে পাঁচ শতাধিক রোগী চিকিৎসা নেন। এ ছাড়া প্রতিদিন ৬০ জনের মতো রোগী ভর্তি থাকছেন। গত এপ্রিলে ৯৭১ জন রোগী ভর্তি হয়েছিলেন। ১ থেকে ২৮ মে পর্যন্ত ৭৯৭ জন রোগী ভর্তি হয়েছিলেন। গরমে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। চলতি ১ থেকে ২৮ মে পর্যন্ত ১৫৮ জন ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর আগে এপ্রিলে ১৮৮ জন ডায়রিয়া রোগী ভর্তি ছিলেন।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সৈয়দ আমীরুল হক শামীম বলেন, জনবল স্বল্পতার কারণে সব কাজ সামলাতে বেগ পেতে হয়। প্রতিদিন নানা ধরনের রোগী বাড়ছে। জ্বালানি তেলে অর্থ বরাদ্দের অভাবে একমাত্র অ্যাম্বুলেন্সটি প্রায় চার মাস নিয়মিত সেবা দিতে পারেনি। যে বাজেট আসে, বছরের অর্ধেকে শেষ হয়ে যায়। দুই সপ্তাহ আগে চার লাখ টাকা বরাদ্দ পেলেও আরও তিন লাখ টাকা প্রয়োজন।