নারায়ণগঞ্জ থেকে বিভিন্ন রুটে চলাচল করছে ঝুঁকিপূর্ণ সানকিন ডেক লঞ্চ। গত শনিবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় লঞ্চ টার্মিনাল ঘাট এলাকায়
নারায়ণগঞ্জ থেকে বিভিন্ন রুটে চলাচল করছে ঝুঁকিপূর্ণ সানকিন ডেক লঞ্চ। গত শনিবার বিকেলে নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় লঞ্চ টার্মিনাল ঘাট এলাকায়

শর্ত না মেনে ঝুঁকি নিয়েই চলছে সানকিন ডেক লঞ্চ 

নিরাপত্তার ঝুঁকি থাকায় নিষেধাজ্ঞা দিয়ে পুরোনো ‘সানকিন ডেক’ লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। এক মাস বন্ধ রাখার পর মালিকদের আবেদনে এক বছরের মধ্যে সানকিন ডেক থেকে হাইডেক রূপান্তরের শর্তে ওই লঞ্চ চলাচলের অনুমতি দেয় বিআইডব্লিউটিএ। তবে গত দুই বছরেও সেই শর্ত বাস্তবায়ন করেননি লঞ্চের মালিকেরা। 

এখন ঝুঁকি নিয়েই সেই পুরোনো সানকিন ডেক লঞ্চ চলাচল করছে। এতে যেকোনো সময় দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। গত তিন বছরে সানকিন ডেক লঞ্চ দুর্ঘটনায় ৪৪ যাত্রীর প্রাণহানি হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, বিআইডব্লিউটিএকে ‘ম্যানেজ’ করেই চলছে পুরোনো এসব লঞ্চ।

বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা যায়, সানকিন ডেক পুরোনো লঞ্চ। এই লঞ্চগুলোর ডেক পানিতে নিমজ্জিত থাকে। লঞ্চ চলাচলে বড় ঢেউয়ের আঘাতে পানিতে স্থির থাকতে পারে না এবং বড় কোনো নৌযানের সঙ্গে ধাক্কা লাগলে সহজেই কাত হয়ে ডুবে যায়। অন্যদিকে হাইডেক লঞ্চ পানির ওপরে থাকে। পানিতে চলাচলের সময় স্থির থাকে। অন্য কোনো নৌযানের সঙ্গে আঘাত লাগলেও পানিতে স্থির থাকতে পারে। সহজেই ডুবে যায় না।

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ থেকে ছয়টি নৌপথে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৬২টি যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল করত। নৌপথগুলো হলো নারায়ণগঞ্জ-চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ-মতলব, নারায়ণগঞ্জ-রামচন্দ্রপুর, নারায়ণগঞ্জ-শরীয়তপুরের নড়িয়া, নারায়ণগঞ্জ-ঈদগাহ ফেরিঘাট ও নারায়ণগঞ্জ-মুন্সিগঞ্জ। প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয় হাজার যাত্রী যাতায়াত করতেন। বর্তমানে এই রুটে ৩৫টি লঞ্চ চলাচল করে। এর মধ্যে ৩২টি সানকিন ডেক লঞ্চ ও ৩টি হাইডেক লঞ্চ। হাইডেক লঞ্চগুলো নারায়ণগঞ্জ-চাঁদপুর রুটে চলাচল করে।

২০২২ সালের ২০ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদীতে বন্দরের আল আমিন নগর এলাকায় কার্গো জাহাজের ধাক্কায় এম এল আফসার উদ্দিন যাত্রীবাহী লঞ্চ ডুবে ১০ জনের মৃত্যু হয়। এম এল আফসার উদ্দিন সানকিন ডেক মডেলের লঞ্চ। এটি নারায়ণগঞ্জ-মুন্সিগঞ্জ রুটে যাত্রী পরিবহন করত। ওই দুর্ঘটনার পর বিআইডব্লিউটিএ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে নারায়ণগঞ্জ রুট থেকে চলাচলকারী সানকিন ডেক লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দেয়। এক মাস নারায়ণগঞ্জ থেকে ছয় নৌপথে সানকিন ডেক লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকে। ওই সময় যাত্রী ভোগান্তি এড়াতে নারায়ণগঞ্জ-মুন্সিগঞ্জ রুটে সি-ট্রাক এবং দুটি হাইডেক লঞ্চ চালু করে বিআইডব্লিউটিএ। পরে মালিকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এক বছরের মধ্যে সানকিন ডেক লঞ্চগুলো হাইডেক রূপান্তরের শর্তে চলাচলের অনুমতি দেয় বিআইডব্লিউটিএ।

এর আগে ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল শহরের সৈয়দপুর কয়লাঘাট এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীতে বেপরোয়া এসকেএল-৩ কার্গো জাহাজের ধাক্কায় যাত্রীবাহী লঞ্চ ‘সাবিত আল হাসান’ ডুবে ৩৪ যাত্রীর মৃত্যু হয়। সাবিত আল হাসান যাত্রীবাহী লঞ্চটি সানকিন ডেক পুরোনো লঞ্চ ছিল। 

সানকিন ডেক লঞ্চ চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ স্বীকার করে বিআইডব্লিউটিএ নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরের (নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক) বাবু লাল বৈদ্য বলেন, পুরোনো এই লঞ্চগুলো হাইডেকে রূপান্তরের শর্তে চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গত দুই বছরেও লঞ্চের মালিকেরা তা বাস্তবায়ন করেননি। তাঁরা চার দফা চিঠি দিয়ে সময় বাড়িয়ে নিয়েছেন। এসব লঞ্চ চলাচলে ঝুঁকি তো আছেই।

নারায়ণগঞ্জের অন্যতম নদী শীতলক্ষ্যা। এই নদীর তীরে নিতাইগঞ্জে আটা-ময়দা, চিনি, ভোজ্যতেল, লবণ, গোখাদ্যের পাইকারি ব্যবসাকেন্দ্র, গোদনাইলে সরকারি জ্বালানি তেলের দুটি ডিপো, দেশের বৃহৎ কয়েকটি শিল্প গ্রুপের খাদ্য উৎপাদনকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান, সিমেন্টসহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পণ্য পরিবহনে কার্গো জাহাজ, বালুবাহী বাল্কহেডসহ প্রতিদিন কয়েক হাজার নৌযান চলাচল করে। ব্যস্ত এ নৌপথে সানকিন ডেক পুরোনো এ ধরনের লঞ্চ চলাচল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। একেকটি সানকিন ডেক লঞ্চ ২০ থেকে ৩০ বছরের পুরোনো।

নারায়ণগঞ্জ-মুন্সিগঞ্জ রুটে নিয়মিত চলাচল করেন সাইফুল ইসলাম। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে তিনি চাকরি করেন। তিনি বলেন, সানকিন ডেক লঞ্চ ছোট হওয়ায় ঢেউয়ের আঘাতে লঞ্চগুলো হেলতে বা দুলতে থাকে। ঝড়বাদলে এসব লঞ্চে চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকিতে আগের তুলনায় অনেক কম যাত্রী এখন লঞ্চে যাতায়াত করেন। এই রুটের আরেক যাত্রী আবুল কালাম বলেন, কার্গো জাহাজের ধাক্কায় দুটি সানকিন ডেক লঞ্চ ডুবে ৪৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। পরে কিছুদিন এ লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকার পর আবার সেই লঞ্চগুলো আগের মতোই চলছে।

এদিকে নৌপথে যাত্রীসংকটে লোকসানের কারণে ধীরে ধীরে নারায়ণগঞ্জ রুট থেকে লঞ্চের সংখ্যা কমে আসছে। আগে এই রুটে ৭০টি চলাচল করলেও সেটি কমে ৩৪টিতে নেমেছে। যেভাবে যাত্রীর সংখ্যা কমে আসছে, আগামী পাঁচ বছর পর লঞ্চের ব্যবসা থাকবে কি না, সেটি নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন মালিকেরা।

নারায়ণগঞ্জ লঞ্চ মালিক সমিতির সভাপতি বদিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ডিজি শিপিং থেকে তাদের মডিফাই নকশা দিচ্ছে না। তারা নতুন লঞ্চ তৈরির নকশা দিচ্ছে। যেহেতু তারা মডিফাই নকশা দিচ্ছে না, যে লঞ্চ আছে, সেগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেলে ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাবে। সানকিন ডেক লঞ্চ ঝুঁকিপূর্ণ নয় দাবি করে তিনি বলেন, ধাক্কা দিলে তো লঞ্চ ডুববেই। হাইডেক করার পর যদি লঞ্চ ডুবে যায়, সেই দায় কে নেবে।

জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তা বাবু লাল বৈদ্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরাও চাই ঝুঁকিপূর্ণ সানকিন ডেক লঞ্চ চলাচল বন্ধ হোক। এ ক্ষেত্রে মালিকদের এগিয়ে আসতে হবে।’

নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সভাপতি এ বি সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনায় এত মানুষের প্রাণহানির পরও কীভাবে এসব লঞ্চ চলাচলের অনুমতি দেয় বিআইডব্লিউটিএ? তারা টাকা খেয়ে জনগণের জীবনের মূল্যের তোয়াক্কা না করে কতিপয় লঞ্চমালিকের স্বার্থে এসব ঝুঁকিপূর্ণ ৩০ থেকে ৪০ বছরের পুরোনো লঞ্চ চলতে দিতে পারে না। দ্রুত এই রুটে হাইডেক লঞ্চ চালু করতে হবে।