বাগেরহাটে দিনদুপুরে সড়কের ওপর গুলি করে এবং কুপিয়ে বিএনপি নেতা সজীব তরফদারকে হত্যার কারণ নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। পরিবারের সদস্যরা বলছেন, এলাকায় জনপ্রিয় নেতা ছিলেন সজীব। তাঁর জনপ্রিয়তাই কাল হয়েছে। এলাকার মানুষ বলছেন, বিএনপির রাজনীতি করার কারণে দীর্ঘ সময় ধরে নানাভাবে অত্যাচার–নির্যাতন সহ্য করেছেন তিনি। তবে সম্প্রতি তাঁর বিরুদ্ধে ঘের দখল, চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ উঠতে শুরু করে, যার জেরে তাঁকে বহিষ্কারও করা হয়েছিল।
হত্যাকাণ্ডের ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও আজ বুধবার বিকেল পর্যন্ত পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় কোনো মামলা করা হয়নি। তবে ঘটনার পর থেকে পুলিশসহ একাধিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছায়া তদন্ত শুরু করেছে। তারা বেশ কয়েকটি বিষয় সামনে রেখে কাজ শুরু করেছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এখনই বিষয়গুলো খোলাসা করতে চায়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে বাগেরহাট সদর উপজেলার মির্জাপুর গ্রামের মধ্যপাড়া এলাকায় বাগেরহাট-রামপাল (গিলাতলা) সড়কে সজীব তরফদারকে (৪২) কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। ঘটনার সময় সজীবের সঙ্গে একই মোটরসাইকেলে থাকা তাঁর চাচা কামাল হোসেন তরফদার (৬৫) গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আহত কামাল তরফদারের চোখে শটগানের গুলি লেগেছে। তাঁকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
সজীব তরফদার বাগেরহাট সদর উপজেলার ডেমা ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক এবং ওই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র বলছে, পাঁচটি বিষয়কে সামনে রেখে হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করছে তারা। এরই মধ্যে কয়েকজন সন্দেহভাজনকেও নজরদারিতে রাখা হয়েছে, যাঁরা হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়ার আগে থেকেই সজীব তরফদারকে অনুসরণ করছিলেন।
পরিবার ও স্থানীয়দের ধারণা, হত্যাকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে ভাড়াটে খুনি দ্বারা। সজীবের ছোট ভাই সোহেল তরফদার বলেন, ‘আমরা চার ভাই, দীর্ঘ বছর ধরেই পরিবারের সবাই বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত। সে (সজীব) দুইবার মেম্বার (ইউপি সদস্য) ছিল। তার ওপর আগেও একাধিকবার হামলা হয়েছে। সবার কাছে জনপ্রিয় ছিল, এই জনপ্রিয়তাই তার কাল হয়েছে।’ তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সজীবের ওপর কয়েকবার হামলা হয়েছে। বিএনপিরও একটি অংশ তাঁকে বারবার মৃত্যুর হুমকি দিয়েছে। তিনি ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের কিছু নেতাও বিএনপির কয়েকজনকে নিয়ে বৈঠক করেছেন। তাঁরা যে সজীবকে মেরে ফেলবেন, এ কথা কল্পনাও করেননি।
এদিকে সজীব হত্যার পর মঙ্গলবার রাতে এবং বুধবার সকালে বাগেরহাট শহরে বিক্ষোভ মিছিল করেছে বিএনপির একটি অংশ। বিক্ষোভ থেকে তাঁরা সজীবের হত্যাকারীদের দ্রুত চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার ও কঠোর শাস্তির দাবি জানান।
সজীবের বাড়ি ডেমা ইউনিয়নের ডেমা গ্রামে। আজ সকাল থেকে তাঁর বাড়ি ঘিরে ছিল স্বজন ও নেতা–কর্মীদের ভিড়। বাড়ির ভেতরে স্ত্রী ও একমাত্র শিশুকন্যার কান্না অশ্রুসিক্ত করছিল স্বজনদেরও। বাগেরহাট জেলা হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে বুধবার দুপুরের কিছু আগে সজীবের মরদেহ বাড়িতে নেওয়া হয়। বিকেলে কাশিমপুর বাজারে জানাজা শেষে তাঁকে ডেমা গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে একাধিকবার নির্যাতনসহ বিভিন্ন মামলায় জেল খেটেছেন সজীব তরফদার। তবে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ডেমা ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে চিংড়িঘের, গরু, মহিষ ও জমি দখল, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দল থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। তবে তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশ্যে কেউ আর তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করছেন না। স্থানীয় আটজন বাসিন্দা এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেছেন, বড় ধরনের চাঁদাবাজি করছিলেন তিনি ও তাঁর দলবল। এখানে ঘেরের এলাকা। প্রচুর কাঁচা টাকা এই এলাকায়। চাঁদাবাজি, দখল নিয়ে অনেকেই ক্ষুব্ধ ছিলেন। হত্যার পেছনে এটাও একটা কারণ হতে পারে।
সজীবের ভাইয়ের ছেলে শোভন তরফদার বলেন, ‘কয়েকজনকে সন্দেহ আছে। দাফনের পর পরিবারের সঙ্গে বসে মামলা করা হবে।’
ঘটনার পর থেকেই পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে জানিয়ে বাগেরহাটের পুলিশ সুপার মো. তৌহিদুল আরিফ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব ধরনের বিষয়কে সামনে নিয়েই আমরা কাজ করছি। কিছু সন্দেহভাজনকেও আমরা ট্র্যাক (নজরদারি) করছি। তদন্তের স্বার্থে এখনই সুনির্দিষ্ট কিছু বলছি না। প্রকৃত হত্যাকারীদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করেই আমরা জানাব।’