খুলনায় গরমের পাশাপাশি পানির কষ্ট

ওয়াসার পানি অনেকটাই ব্যবহারের অনুপযোগী। নলকূপে পানি উঠছে না। সাবমার্সিবল পাম্পে লাইন ধরে পানি নিচ্ছেন এলাকাবাসী।

গরমের চার মাস খুলনায় পানির স্তর নেমে যায়। তাই নলকূপ থেকেও পানি উঠতে চায় না। যে কলস ভরতে ২ মিনিট লাগে, তা এখন লাগে প্রায় ১০ মিনিট। গতকাল খুলনার মুজগুন্নী এলাকায়

খুলনা নগরের মুজগুন্নী আবাসিক এলাকার ২২ নম্বর রোডের মাথায় একটা গভীর নলকূপ থেকে পানি নিচ্ছিলেন মেহেরুন্নেসা। কয়েক চাপ দেওয়ার পর একটু একটু পানি উঠছিল। মেহেরুন্নেসা মানুষের বাড়িতে পানি দেন। প্রতিদিন ৬০ কলস পানি দিতে হয়। পানি না ওঠায় মেহেরুনের কষ্ট আর শ্রম অনেক গুণ বেড়ে গেছে।

কড়া পড়ে যাওয়া হাত দেখিয়ে মেহেরুন বললেন, মাস তিনেক ধরে পানির এই অবস্থা। আগে বেলা তিনটার মধ্যে সব বাসায় পানি দেওয়া শেষ হতো। এখন রাত আটটা বেজে যায়। তাঁর ওপর যে গরম, তাতে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে।

খুলনা নগরে ১৫ লাখ মানুষের বসবাস। প্রতিদিনের পানির চাহিদা ২৪ কোটি লিটার। নগরে পানির সরবরাহব্যবস্থার দায়িত্বে থাকা খুলনা ওয়াসা ৪০ হাজার বাড়িতে দিনে ৭ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করতে পারছে। গরমের মৌসুমে ওয়াসার সরবরাহ করা সেই লবণাক্ত পানি আবার ব্যবহারের অনুপযোগী। এদিকে এই সময়ে শহরের বেশির ভাগ নলকূপেই পানি ওঠে না। এ কারণে প্রচণ্ড গরমের এই সময় সাবমার্সিবল পাম্পেই ভরসা খুঁজতে হচ্ছে খুলনার মানুষকে।

খুলনা ওয়াসা বলছে, এখনো পর্যন্ত গ্রাহকের চাহিদামতো পানি সরবরাহ করতে পারলেও বিদ্যুৎ পরিস্থিতি শিগগিরই ভালো না হলে সংকটের আশঙ্কা দেখছেন তাঁরা।

আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, এক সপ্তাহ ধরে খুলনায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৮ থেকে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকছে। সঙ্গে জলীয় বাষ্প বেশি থাকায় গরমের অনুভূতি আরও তীব্র হচ্ছে।

মঙ্গলবার দুপুরে নগরের শেখপাড়া বাজার এলাকায় একটি সাবমার্সিবল পাম্পের পাশে পানির জন্য অপেক্ষা করছিলেন জনাদশেক নারী। তাঁদের একজন হেলেনা বেগম প্রায় আধা কিলোমিটার দূর থেকে পানি নিতে এসেছেন। হেলেনাদের বাসায় ওয়াসার লাইন থাকলেও তিন দিন ধরে তাতে পানির দেখা মেলেনি। দূর থেকে টেনে নেওয়া পানিতে তাঁদের পাঁচজনের পরিবারের খাওয়া, রান্নাবান্না, গোসল সবই করতে হচ্ছে। হেলেনা বেগম বলেন, এমনিতেই ওয়াসার পানি লবণের জন্য খাওয়া যায় না। তার ওপর তিন দিন ধরে পানি আসে না। খুব কষ্টে আছেন তাঁরা।

খালিশপুর এলাকায় ১১ নম্বর ওয়ার্ডের পিপলস নিউ কলোনি নামের শ্রমিক কলোনিতে ৩৬৪ পরিবারের বাস। সেখানে ওয়াসার সংযোগ পৌঁছায়নি। ফলে পানি নিয়ে তাদের চরম দুর্গতি। খালিশপুরের ওই এলাকার মতো নগরের দৌলতপুর এলাকার ছয়টি ওয়ার্ডের বেশির ভাগ বাড়িতে ওয়াসার পানির সংযোগ নেই। সেখানকার নলকূপেও পানি ওঠে না। সেখানকার বেশির ভাগ পুকুর নানাভাবে বন্ধ হওয়ায় গোসলের পানির চরম সংকটে আছেন তাঁরা।

পানির সংকটের বিষয়ে ৫ নম্বর ওয়ার্ডের (দৌলতপুর এলাকা) কাউন্সিলর শেখ মোহাম্মদ আলী বলছিলেন, পুরোনো নলকূপগুলোতে গরমের সময় পানি পাওয়া যায় না। আর পাঁচ বছর ধরে বহু আবেদন–নিবেদন করে সর্বোচ্চ ১ শতাংশ বাড়িতে ওয়াসার পানির সংযোগ হয়েছে।

সিটি করপোরেশনের সদর এলাকায়ও পানির তীব্র সংকট। বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলররাসহ নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীরা বেশ কিছু মোড়ে সাবমার্সিবল পাম্পের মাধ্যমে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করেছেন। মেসে থাকা শিক্ষার্থীসহ নিম্ন আয়ের বেশির ভাগ মানুষ সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করেন। অনেকে আশপাশের বহুতল ভবনমালিকদের বসানো সাবমার্সিবল পাম্পের ওপর ভরসা করছেন।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) খুলনার সমন্বয়কারী মো. বাবুল হাওলাদার বলেন, ‘খুলনা ওয়াসা আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে মধুমতী নদীর পানির যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, তা শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হলো না। আমরা আগেই এর বিরোধিতা করেছিলাম।’

ওয়াসা সূত্র জানা গেছে, বাগেরহাটের মোল্লাহাট সেতুসংলগ্ন এলাকা থেকে মধুমতী নদীর পানি সংগ্রহের পর পরিশোধনের মাধ্যমে নগরে সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে মধুমতী নদীতে শুষ্ক মৌসুমে লবণ বাড়ায় চার বছর ধরে মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত ওয়াসার পানি লবণাক্ত থাকছে। ২০১১ সালে যখন মধুমতী থেকে পানি আনার প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়, তখন মধুমতীর পানিতে লবণাক্ততা এমন ছিল না বলে দাবি ওয়াসার।

গত কয়েক দিন খুলনা নগরে লোডশেডিং নেই বললেই চলে। তবে ওয়াসার মূল প্ল্যান্ট রূপসা উপজেলায়। সেখানে বিদ্যুৎ–সংকট আছে। খুলনা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল্লাহ পানিতে লবণাক্ততার বিষয়ে বলেন, অতিরিক্ত শুষ্ক মৌসুমে বৃষ্টি না হওয়ায় নদীর পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাচ্ছে। সে কারণে এই সময়ে পরিশোধনের পরও পানিতে সামান্য লবণ থেকে যাচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে এটা থাকে না।