মোরেলগঞ্জ উপজেলার বহরবুনিয়া এলাকার পানগুছি নদীর তীরের আশপাশের বহু বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। আজ সোমবার সকালের চিত্র
মোরেলগঞ্জ উপজেলার বহরবুনিয়া এলাকার পানগুছি নদীর তীরের আশপাশের বহু বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। আজ সোমবার সকালের চিত্র

‘এবারই মনে হয় এত লম্বা সময় ধরে ঝোড়ো বাতাস হচ্ছে’

বাগেরহাটে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ঝোড়ো হাওয়া ও টানা বৃষ্টিতে জেলার কয়েকটি নদ-নদীর পানি ৪ থেকে ৮ ফুট পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসের পানির চাপে বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। এতে বাঁধ উপচে প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন লোকালয়। ইতিমধ্যে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে সহস্রাধিক পরিবার। সেই সঙ্গে ভেসে গেছে কয়েক হাজার মাছের ঘের।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ এস এম রাসেল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে আশপাশের অসংখ্য মৎস্যঘের ভেসে গেছে। এই পানি না নামা পর্যন্ত প্রকৃত চিত্র বোঝা সম্ভব নয়। প্রাথমিকভাবে জেলায় প্রায় ২২ হাজার মৎস্যঘের তলিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মোংলা, মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা ও রামপাল উপজেলায়।

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে আশপাশের অসংখ্য মৎস্যঘের ভেসে গেছে। এই পানি না নামা পর্যন্ত প্রকৃত চিত্র বোঝা সম্ভব নয়। প্রাথমিকভাবে জেলায় প্রায় ২২ হাজার মৎস্যঘের তলিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মোংলা, মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা ও রামপাল উপজেলায়।
এ এস এম রাসেল, জেলা মৎস্য কর্মকর্তা

রামপাল উপজেলার বাইনতলা চাকশ্রী গ্রামের চিংড়িচাষি শেখ নূর ইসলাম বলেন, গতকাল রাতে জোয়ারের পানির চাপে ঘেরের বাঁধ ভেঙে প্রায় এক লাখ টাকার চিংড়ি মাছ ভেসে গেছে।

ঘের ব্যবসায়ী ডালিম শেখ বলেন, ‘জোয়ারের পানির চাপ এতটাই প্রবল ছিল যে মুহূর্তের মধ্যেই আমার ঘের পানিতে তলিয়ে যায়। রাত থেকে আমার ঘেরসহ এখানকার প্রায় অর্ধশত মাছের ঘের পানিতে তলিয়ে আছে।’

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গতকাল রাত ১২টা থেকে বাগেরহাটের নদ-নদীগুলোতে অস্বাভাবিক মাত্রায় পানি বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। আজ সোমবার দুপুর পর্যন্ত এ প্রবণতা দেখা গেছে। এতে পানগুছি নদীর তীরসংলগ্ন মোরেলগঞ্জ, বলেশ্বর তীরবর্তী শরণখোলা, পশুর নদের তীরবর্তী মোংলা, কুমারখালী ও ঘষিয়াখালী তীরের রামপাল ও বাগেরহাট ভৈরব ও দরটানা নদীতীরের সদর উপজেলার বাঁধ উপচে ও ভেঙে অন্তত ৭০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে গাছপালা ভেঙে পড়েছে।

আজ সকালে বাগেরহাট সদর উপজেলার মাঝিডাঙ্গা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, দুই শতাধিক পরিবার পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। ভৈরব নদীর পানিতে তলিয়ে গেছে তাঁদের বাড়িঘর। স্থানীয় বাসিন্দা ডেইজি বেগম বলেন, রাত দুইটার দিকে মাঝিডাঙ্গা-পোলঘাট সড়কের ওপর দিয়ে পানি এসে এলাকাটি তলিয়ে যায়। এর আগেই সড়কের বিপরীত পাশে থাকা শতাধিক পরিবারের বাড়িঘর প্লাবিত হয়েছিল। পানিতে ঘরের আসবাব, ফ্রিজ, বিছানা—সবকিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রান্না করে খাওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। সবখানেই পানি। এ ছাড়া উপজেলার চরগ্রাম, ভদ্রপাড়া, সুলতানপুর, ভাঙ্গনপাড়, রহিমাবাদ, ডেমাসহস অন্তত ১০ গ্রাম প্লাবিত হয়ে পানিবন্দী রয়েছেন বাসিন্দারা।

এত পানি আগে দেখিনি। ঝড় তো মাঝেমধ্যেই হয়। তবে এবারই মনে হয় এত লম্বা সময় ধরে ঝোড়ো বাতাস হচ্ছে। নদীতে ভাটা হইছে, কিন্তু পানি কমেনি। গতকাল দুপুরে জোয়ারে যেমন পানি ছিল। আজ সকালে ভাটাতেই সেই পরিমাণ পানি।
সুলতানপুর এলাকার শহিদুল ইসলাম

সুলতানপুর এলাকার শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এত পানি আগে দেখিনি। ঝড় তো মাঝেমধ্যেই হয়। তবে এবারই মনে হয় এত লম্বা সময় ধরে ঝোড়ো বাতাস হচ্ছে। নদীতে ভাটা হইছে, কিন্তু পানি কমেনি। গতকাল দুপুরে জোয়ারে যেমন পানি ছিল। আজ সকালে ভাটাতেই সেই পরিমাণ পানি।’

এদিকে শরণখোলা উপজেলার রায়েন্দা ইউনিয়নের রাজৈর এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। যার ফলে ওই এলাকার পাঁচ শতাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পেড়েছে। এ ছাড়া একই উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়নের বগি ও চালিতাতলা এলাকায় রিং বেড়িবাঁধ উপচে পানি প্রবেশ করে অন্তত তিনটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

শরণখোলার তাফালবাড়ি এলাকার নাজমুল বলেন, ‘আমাদের এলাকা বিদ্যুৎ–বিচ্ছিন্ন রয়েছে। সব সময় মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কও পাওয়া যাচ্ছে না। সব মিলে আমরা খুব আতঙ্কের মধ্যে আছি।’

জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে উঁচু জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসে বাগেরহাটের তিন উপজেলার অন্তত পাঁচটি এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকেছে। এর মধ্যে মোরেলগঞ্জ উপজেলার বলইবুনিয়ার শ্রেণিখালী এলাকায় পানগুছি নদীতীরবর্তী দৈবজ্ঞহাটি উপপ্রকল্পের দুটি স্থানে ১০ মিটার ও একই নদীর পঞ্চকরণের দেবরাজ এবং কুমারিয়াজোলা এলাকায় ৪০০ মিটার, শরণখোলা উপজেলার রায়েন্দা খালের রাজৈর এলাকায় ৩৫/১ পোল্ডারের ৮০ মিটার এবং বাগেরহাট সদর উপজেলার ভৈরব নদতীরবর্তী গোপালকাঠি এলাকার নাজিরপুর উপপ্রকল্পের ৪০ মিটার ও দড়াটানা নদীর বিষ্ণুপুর এলাকার বেমরতা উপপ্রকল্পে ৬ মিটার বাঁধ জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এ ছাড়া মোরেলগঞ্জ, মোংলা ও রামপাল উপজেলায় বাঁধের বাইরে থাকা বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে পুরো সুন্দরবন। করমজলসহ বনের উঁচু এলাকাগুলোও দুপুরের জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে বন্য প্রাণীর বড় ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। অন্যদিকে নদীতে ভাটা এলেও পানি কমছে না। ফলে দুপুরের জোয়ারে আবারও নতুন করে বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।