কুষ্টিয়ায় সরকারি শিশু পরিবার (বালক) থেকে এক শিশু নিখোঁজের ঘটনায় সেখানে দায়িত্বরত কর্মকর্তা সহকারী তত্ত্বাবধায়ক ইলিয়াস হোসেনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাঁর স্থলে সমাজসেবা কার্যালয়ের আরেক কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শিশু নিখোঁজের ঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী তিন দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক আবদুল লতিফের কাছে দিতে বলা হয়েছে।
জেলা প্রশাসন ও সমাজসেবা সূত্র জানায়, গত ২ নভেম্বর কুষ্টিয়া সরকারি শিশু পরিবার (বালক) থেকে রাইহান হোসেন ওরফে রিজভী (১২) নামে সপ্তম শ্রেণিপড়ুয়া এক শিশু নিখোঁজ হয়। এরপর ৪ নভেম্বর কুষ্টিয়া মডেল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে সমাজসেবা কর্তৃপক্ষ। গতকাল সন্ধ্যায় শহরের চৌড়হাস এলাকায় সরকারি শিশু পরিবার (বালক) চত্বরে বের হয়ে শিশুরা বিক্ষোভ করলে বিষয়টি জানাজানি হয়। এ সময় জেলা প্রশাসন ঘটনাটি প্রথম জানতে পারে। ওই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও অভিভাবক হলেন জেলা প্রশাসক।
এরপর শিশু পরিবারে পুলিশ গিয়ে দায়িত্বরত উপতত্ত্বাবধায়ক আসাদুজ্জামান ও সহকারী তত্ত্বাবধায়ক ইলিয়াস হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নেয়। কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শিহাবুল ইসলাম বলেন, গভীর রাতে সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক আবদুল লতিফের জিম্মায় তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
আবদুল লতিফ প্রথম আলোকে বলেন, ইলিয়াস হোসেনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাঁর স্থলে আরেকজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে যাঁর যাঁর দায় পাওয়া যাবে, তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। উপপরিচালক আরও বলেন, এত বড় ঘটনা ঘটলেও তাঁকে পর্যন্ত জানানো হয়নি। ঘটনার চার দিন পর ৬ নভেম্বর তিনি বিষয়টি জানতে পারেন। এটা দায়িত্ব অবহেলা বলে তিনি উল্লেখ করেন। এ কাজ করা ঠিক হয়নি বলে জানান কর্মকর্তারা।
কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক তৌফিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি আমাকেও জানানো হয়নি। ওই প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়। তাঁরা কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। শিশুটিকে উদ্ধারে পুলিশ কাজ করছে। এ ছাড়া এ ব্যাপারে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।’
হারানো ফুফাতো ভাইয়ের খোঁজে কুষ্টিয়ায় আসেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফাতেমা তুজ জোহরা। তিনি বলেন, ২ নভেম্বর তাঁর ভাই নিখোঁজ হলেও তাঁরা জানতে পারেন ৪ নভেম্বর। একই দিন নিখোঁজ রাইহানের ব্যাগ খুলনাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেসে পাওয়া যায়। তিনি দাবি করেন, তাঁর ভাইকে নির্যাতন করা হয়েছে।
এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় শিশু পরিবার প্রাঙ্গণে প্রতিষ্ঠানে থাকা সব শিশু বের হয়ে বিক্ষোভ করে। সে সময় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বিক্ষোভের সময় শিশুরা নানা অনিয়মের কথা তুলে ধরে।
বিক্ষোভ চলাকালে উপতত্ত্বাবধায়ক আসাদুজ্জামান বলেন, ২ নভেম্বর দুজন শিক্ষার্থী রাইহান ও নাহিদ প্রধান ফটক দিয়ে বের হয়ে যায়। তাদের সন্ধান না পেয়ে ৪ নভেম্বর থানায় জিডি করা হয়।
সহকারী তত্ত্বাবধায়ক ইলিয়াসের বিরুদ্ধে শিশুদের ওপর শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। তিনি সেই অভিযোগ অস্বীকার করেন। তবে নাহিদকে মারধরের কথা স্বীকার করেছেন ইলিয়াস। তিনি বলেন, ‘নাহিদ যেহেতু রাইহানের সঙ্গে গিয়েছিল এবং পরে ফিরে এসেছে, তাই তার কাছ থেকে সত্য তথ্য জানতে মারধর করা হয়েছে। এ জন্য আমি একা দায়ী নই।’
এক শিক্ষার্থী বলে, ‘এখানে আমাদের খুব মারধর করা হয়। পেটভরে খেতে দেওয়া হয় না। কাউকে কিছু বললে মারার হুমকি দেয়।’
কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আবদুল ওয়াদুদ প্রথম আলোকে বলেন, বিক্ষোভের বিষয়টি জানার পরপরই সেখানে যাওয়া হয়। কয়েকজন শিশুর সঙ্গে কথাও বলা হয়। তাদের বরাত দিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, রাইহান ও আরও এক শিশু ২ নভেম্বর ট্রেনযোগে ঢাকায় যায়। পরে তারা রাতে কমলাপুরে রাতযাপন করে। ৩ নভেম্বর আবার সুন্দরবন এক্সপ্রেসে কুষ্টিয়ায় আসে। সেখানে সঙ্গে থাকা নাহিদ নামে এক শিশু কুষ্টিয়ায় নেমে যায়। কিন্তু রাইহান খুলনায় চলে যায়। এরপর ট্রেনে ব্যাগ রেখে নেমে পড়ে। পরে তার কোনো হদিস মেলেনি।
এই কর্মকর্তা শিশু নাহিদের সঙ্গে অনেকবার কথা বলেছেন। তাতে আরও জানতে পেরেছেন, নাহিদের কাছ থেকে রাইহানের তথ্য জানতে ইলিয়াসসহ কয়েকজন নাহিদকে তিন দফায় মারধর করেন। এতে সে চরম ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। তার শরীরে আঘাতের চিহ্নও দেখা গেছে।
তদন্ত কমিটির প্রধান সমাজসেবা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ মুরাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, শিশুদের মারধর করার কোনো বিধান নেই। সঠিক তদন্ত করে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।