বাজারে একই মোড়কে বিক্রি হচ্ছে ভারতীয় ও দেশি চিনি। দামের ফারাক ছাড়া দেখে বোঝার উপায় নেই কোনটি ভারতীয় আর কোনটি দেশি চিনি।
একই মোড়ক দেওয়া দুটি বস্তার চিনি দেখতে অনেকটা একই রকম। ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে, এক বস্তার চিনির দানা কিছুটা বড়, অন্যটি ছোট। কোনোটির রং কিছুটা ময়লা। যদিও সাধারণ ক্রেতাদের দেখে চেনার উপায় নেই। দামের ফারাক শুনলে মনে হবে, কোথাও সমস্যা আছে। এই চিনির কোনোটি দেশি, কোনোটি ভারতীয়।
সিলেটের পাইকারি বাজার কালীঘাট ঘুরে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে। অবৈধ পথে সীমান্ত এলাকা দিয়ে দেশে ঢুকছে ভারতীয় চিনি। এসব চিনিকে সিলেটে ‘বুঙ্গার চিনি’ বলা হয়। আগে সিলেটের বাজারে ও ভোক্তাদের কাছে এসব চিনি বিক্রি হলেও সম্প্রতি চিনির দাম বাড়ায় তা দেশের নানা প্রান্তে যাচ্ছে। যার কিছু অংশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে জব্দ হচ্ছে।
পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ভারতীয় চিনি ৫০ কেজির বস্তা বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার থেকে ৬ হাজার ১০০ টাকায়। দেশি চিনি ৬ হাজার ৭০০ থেকে ৬ হাজার ৮৫০ টাকায়। পাইকারি বাজারে দেশি চিনির বস্তায় বুঙ্গার চিনি দেখা যায়। কালীঘাটের রুদ্র এন্টারপ্রাইজে ক্রেতা হিসেবে ভারতীয় চিনি চাইলে তিনি দেশি চিনি আছে বলে জানান। ৬ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি করবেন। চিনি দেখে সেটিকে বুঙ্গার চিনি বলে জানালে তিনি বলেন, এখন এগুলোই দেশি চিনি।
মাছুম অ্যান্ড ব্রাদার্সের বিক্রেতা মাখন আহমদ বলেন, তাঁর কাছে ভারতীয় চিনি আছে। তবে দেশি চিনি নেই। ভালো মানের ভারতীয় চিনি বস্তাপ্রতি ৬ হাজার টাকায় বিক্রি করছেন। আনিসা ট্রেডার্সের বিক্রেতা আরিফ আহমদ খুচরা চিনি বিক্রি করছেন বলে জানালেন। বস্তা বিক্রি করছেন না। মেসার্স ইনসাফ ট্রেডার্সে গেলে বিক্রেতা তাঁর দোকানে কোনো চিনি বিক্রি করছেন না বলে জানান।
কালীঘাটের হোসেন ব্রাদার্সের ব্যবসায়ী ফাহাদ মো. হোসেন বলেন, তাঁরা নিত্যপণ্য বিক্রি করেন। সরাসরি সরবরাহকারীদের কাছ থেকে চিনি নেন না। ক্রেতারা অন্য মালামালের সঙ্গে চিনি চাইলে অন্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আনিয়ে দেন। তিনি বলেন, কয়েকজন ব্যবসায়ী আছেন। তাঁদের কাছ থেকেই অন্য ব্যবসায়ীরা এ চিনি নেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালীঘাটের তিনজন ব্যবসায়ী বলেন, সম্প্রতি সিলেটের বাজারে বুঙ্গার চিনি আসা কমেছে। আগে প্রতিদিন ভোরে ২০–২৫টি ট্রাকে ভারতীয় চিনি নিয়ে আসতেন ব্যবসায়ীরা। পরে সেগুলো গুদামে রাখা হতো। এখন সেই সংখ্যা ৫–১০তে ঠেকেছে। ট্রাকের সামনে–পেছনে মোটরসাইকেল নিয়ে পাহারা দিয়ে গুদামে পৌঁছে দেয় একটি চক্র।
খুচরা বাজারে বুঙ্গার চিনি ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। দেশি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকা কেজি। নগরের মাছুদীঘির পাড় এলাকার ব্যবসায়ী পীযূষ দাশ বলেন, বর্তমানে ভারতীয় চিনি ১৩৫ ও দেশি চিনি ১৫০ টাকায় খুচরা বিক্রি হচ্ছে। ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখ পর্যন্ত তিনি ভারতীয় চিনি ১৩০ ও দেশি চিনি ১৪৫ টাকায় বিক্রি করেছেন।
সিলেটের জৈন্তাপুরে সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা হাবিবুর রহমান (ছদ্মনাম) বলেন, ভারতে খুচরা বাজারে বাংলাদেশি ৭০ টাকায় ১ কেজি চিনি পাওয়া যায়। সেই হিসাবে ৫০ কেজির বস্তার দাম সাড়ে তিন হাজার টাকা। তবে ভারত থেকে সরাসরি বস্তা হিসেবে কিনলে ৩ হাজার ২০০ থেকে ৩ হাজার ৩০০ টাকায় পাওয়া যায়। তিনি বলেন, এসব চিনি জৈন্তাপুরের হরিপুর এলাকা থেকে হাতবদল হয়। এরপর দাম বাড়তে থাকে। সিলেটের বাজারে পৌঁছাতে ৫ হাজার ২০০ টাকা হয়ে যায়।
গোয়াইনঘাটের জাফলং এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, মূলত গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর ও কানাইঘাট থেকে অবৈধ পথে বুঙ্গার চিনি সিলেটে প্রবেশ করে। পরে হাতবদল হয়ে সিলেট শহর থেকে শুরু করে ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রামসহ দেশের নানা প্রান্তে যায়। এসব চিনি গন্তব্য পর্যন্ত ভারতীয় মোড়কেই যায়।
সিলেট মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মহানগর পুলিশের অভিযানে ৩২৭ বস্তা ভারতীয় চিনি জব্দ করা হয়েছে। যার বাজারমূল্য ১৩ লাখ ৩৫ হাজার ৯০০ টাকা। এ ঘটনায় করা মামলায় ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদিকে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অভিযানে ২৮৬ বস্তা ভারতীয় চিনি জব্দ করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছেন ছয়জন। গত শনিবার সকালে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ৫৯৫ বস্তা ভারতীয় চিনিসহ দুটি ট্রাক এবং জড়িত দুজনকে আটক করে।
মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, চোরাচালান প্রতিরোধে তৎপর আছে পুলিশ। এরই অংশ হিসেবে অবৈধ পথে আসা বিপুল পরিমাণ মালামাল জব্দ হচ্ছে। ভারতীয় চোরাচালান ও মাদক প্রতিরোধে পুলিশের অভিযান চলছে।