প্রায় ২৪ কাঠা জায়গার ওপর পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের ডুপ্লেক্স বাড়ি। গতকাল দুপুরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণবাগ এলাকায় আনন্দ হাউজিং সোসাইটিতে
প্রায় ২৪ কাঠা জায়গার ওপর পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের ডুপ্লেক্স বাড়ি। গতকাল দুপুরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণবাগ এলাকায় আনন্দ হাউজিং সোসাইটিতে

বেনজীরের রূপগঞ্জের বাড়ি স্থানীয়দের কাছে ‘রহস্য’

এক পাশে ডেমরা-ইছাপুরা (রূপগঞ্জ) সড়ক। অন্য পাশে আনন্দ হাউজিং সোসাইটির কৃত্রিম লেক। লেকের পাশে ২৪ কাঠা জায়গাজুড়ে লাল রঙের আলিশান ডুপ্লেক্স বাড়ি।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণবাগ এলাকার এই বাড়ির মালিক পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ। আট বছর আগে এলাকার প্রয়াত প্রেমানন্দ সরকারের সন্তানদের কাছ থেকে ১ কোটি ৮৩ লাখ টাকায় ৫৫ শতাংশ জায়গা কেনেন তিনি। পরে বছর চারেক আগে এই জমিতে ওই বাড়ি করেন তিনি। তাঁর ওই বাড়ি ঘিরে স্থানীয় মানুষদের মধ্যে তৈরি হয়েছে নানা গল্প, রহস্য।

গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা হয়, লাল ইটের দোতলা বাড়ি। কাঠের কারুকাজ করা সদর দরজা। দেয়ালে শীতাতপযন্ত্র আর সিসিটিভি ক্যামেরা। বাড়ির প্রধান ফটকের কাছে যেতেই ভেতর থেকে দুটি কুকুর দৌড়ে এসে চিৎকার করতে থাকে। ফটকের পাশের একটি কক্ষ থেকে বের হয়ে আসেন বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক আবদুল্লাহ। বাড়ির ভেতরে দাঁড়িয়েই তিনি বলেন, দেড় মাস ধরে বাড়ি দেখভালের দায়িত্বে আছেন তিনি। এ সময় বেনজীরের পরিবারের কেউ এখানে আসেননি।

বাড়ির বাইরে থেকে ভেতরে দেশি জাতের কিছু মোরগ-মুরগি, একটি বড় খাঁচায় দুটি ম্যাকাও জাতের পাখি এবং কিছু পাখির খালি খাঁচা দেখা যায়। এ ছাড়া বাড়িজুড়ে কিছু ফুল, ফল ও ঔষধি গাছ দেখা যায়। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে আবদুল্লাহ জানান, ‘বাড়ি দেখভাল করলেও ভবনের ভেতরে প্রবেশে তাঁদের অনুমতি নেই। ভবনের চাবি বেনজীর আহমেদের পরিবারের কাছে।’

স্থানীয় কয়েকজন কিশোর-তরুণকে উঁচু দেয়ালঘেরা বাড়িটির পাশের লেকে ডুবসাঁতার কাটতে দেখা যায়। এ সময় কথা হয়, ১৮ বছরের এক তরুণের সঙ্গে। এই বাড়ির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি একগাল হেসে বলেন, ‘শুনছি বাইরের মতো বাড়ির ভেতরও নাকি রাজপ্রাসাদের মতো। সব বিদেশি জিনিসপত্র। বেনজীর দেশ ছাইড়া পালানোর পর রাইতের বেলা নাকি অনেক জিনিসপত্র সরাইয়া নিয়া গেছে।’ বাড়িটি  ঘুরে দেখার শখ ওই তরুণের সঙ্গে থাকা ১৫ বছরের এক কিশোরের। কিশোরের এমন শখের কারণ জানতে চাইলে সে জবাব দেয়, ‘বাড়ির ভেতর একটা কাচের বাথরুম আছে। হেইডা নাকি আমাগো ঘরের থেইকাও বড়। আমি বাথরুমডা দেখতে চাই।’

বেনজীরের বাড়ির ৩০০ মিটার দক্ষিণে কয়েক ঘরের বসতি। কথা হয় সেখানকার বাসিন্দাদেরও সঙ্গে। কুড়িগ্রামের আবদুল গণি ১৭ বছর ধরে ওই এলাকায় ভাড়া থাকেন। গণির ঘর থেকে বেনজীরের বাড়ি দেখা যায়। গণি বলেন, প্রায় সময়ই পুলিশের সাইরেন বাজিয়ে গাড়ির বহর নিয়ে বাড়িতে আসতেন বেনজীর। পুলিশের নিরাপত্তার কড়াকড়ির কারণে তখন বাড়ির পাশের সড়ক দিয়ে লোকজনের চলাচলও বন্ধ করে দেওয়া হতো। বেনজীরের সঙ্গে মাঝেমধ্যে আসতেন চেনা-অচেনা সংগীতশিল্পী ও নাটক-সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। তখন বাড়িতে গানের আসর বসত। গানের উচ্চ শব্দে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটত স্থানীয় মানুষদের, কিন্তু কখনোই ভয়ে কিছু বলেননি।

গণি জানান, আলোঝলমলে বাড়িতে আসা লোকজনকে দূর থেকে দেখতেন তাঁরা। তবে অন্তত দুই মাস ধরে বাড়িতে কোনো গাড়ির বহর আসতে দেখা যায়নি। তিন দিন হলো বাড়িতে আগের মতো আলোও জ্বলতে দেখা যাচ্ছে না।

গণির সঙ্গে কথা বলার সময় সেখানে আসেন তাঁর এক প্রতিবেশী নারী। নাম প্রকাশ করার শর্তে ওই নারী বলেন, ‘বাড়ির জায়গা আছিল হিন্দুদের। প্রথমে হাউজিংয়ের লোকজন জোরজবরদস্তি কইরা ওই জমি ভরাট করেন। পরে বেনজীর জোর কইরা জায়গা কিনরছে। এই জমিতে ঘর করছে, এত রং-তামাশা করছে, কোনো দিনও এলাকার মানুষদের কাজে নেয় নাই, বাড়িতেও যাইতে দেয় নাই। এই বাড়ির ভেতর কী হয়, কারা আসে, কী আছে—কিছুই আমরা জানি না। পুরা বাড়িটাই আমাগো কাছে একটা রহস্য।’

স্থানীয় বাসিন্দা আরশাদ আলী জানান, বাড়ি ও বাড়ির আশপাশে সিসিটিভি ক্যামেরা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বাড়ির কুকুরের চিৎকার আর পাহারায় থাকা লোকজনের খারাপ আচরণের কারণে তাঁরা বাড়ির পাশ দিয়ে হাঁটতেও ভয় পান।

বেনজীরের এই বাড়ি থেকে ৫০০ গজ দক্ষিণে ২২ ঘর হিন্দুধর্মাবলম্বীর বসতি। স্থানীয় মানুষেরা জানালেন, ওই হিন্দু পরিবারগুলোর কাছ থেকে জোর করে কেনা জমির ওপর তিনি এই বাড়ি করেছেন।

গতকাল বিকেলে হিন্দুপাড়াটিতে গিয়ে কথা হয়, প্রয়াত প্রেমানন্দ সরকারের ছেলে রামধন সরকারের সঙ্গে। তিনি বলেন, তাঁরা চার ভাই পৈতৃক সূত্রে ৫৫ শতাংশ জলাশয় পেয়েছিলেন। তাঁদের কাছ থেকে না কিনেই আনন্দ হাউজিংয়ের নামে বালু দিয়ে জলাশয়টি ভরাট করা হয়। জমি ভরাটের বছর চারেক পর লোক মারফতে এক কোটি টাকা বিঘা দরে জমিটুকু বিক্রি করেন তাঁরা।

ওই পাড়ায় কথা হয় স্থানীয় এক কাঠমিস্ত্রির সঙ্গে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, বেনজীরের বাড়ির টুকিটাকি কাজ করার জন্য তাঁকে কয়েক দফায় ডেকে নেওয়া হয়েছিল। প্রথমবার বাড়ির ভেতরে ঢুকে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। তাঁর ভাষায়, ভেতরে কাচের সিঁড়ি। প্রথমবার উঠতে পা কাঁপতাছিল। আমাগোর ঘরের সমান বড় বাথরুম। পুরা বাথরুম কাচের, এসি করা। তখন বাড়ির দারোয়ান বলছিল, বাড়ির সব জিনিসপত্র নাওড়ার (রূপগঞ্জের কায়েতপাড়া ইউনিয়নের একটি গ্রাম) এক জমি ব্যবসায়ী বিদেশ থেইকা আইনা দিসে।’

ওই মিস্ত্রির নাম জানতে চাইলে তিনি নাম প্রকাশে নিজের ভীতির কথা জানান। তাঁর কাছে জানতে চাই, বেনজীর দুর্নীতির দায়ে বিদেশে থাকার পরও তিনি ভয় পাচ্ছেন কেন। মিস্ত্রি বলেন, ‘এক বেনজীর দেশ ছাড়ছে, আরও কত বেনজীর এই রূপগঞ্জেই আছে। বেনজীররা দেশ ছাড়ে ঠিকই, কিন্তু ক্ষমতা তাগো ছাড়ে না। তারা দেশের বাইরে থাকলেও আমাগো মতো মানুষরে মশার মতো পিষ্যা (পিষে) ফেলতে পারে।’