বেলা ১১টা। শেখ হাসানুজ্জামান নামে ভারতীয় একজন নাগরিক শূন্যরেখা পেরিয়ে যশোরের বেনাপোল ইমিগ্রেশনে পৌঁছান। প্রবেশমুখেই একটি টেবিল নিয়ে সাদাপোশাকে কয়েকজন বসা। সেখানে বিদেশিদের প্রস্থান নথি (এমবারকেশন কার্ড) পূরণ করে দিয়েই ‘এন্ট্রি ফি’র নামে হাসানুজ্জামানের কাছ থেকে ২০০ টাকা নেওয়া হয়। এর বিপরীতে কোনো রসিদ পাননি তিনি।
গত রোববার যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দরের ইমিগ্রেশনে গিয়ে এই চিত্র দেখা গেছে। শুধু ভারতীয় নাগরিক হাসানুজ্জামান নন, ভারত থেকে ফেরা বাংলাদেশি নাগরিকদের কাছ থেকেও দালাল ও পুলিশ চক্র মিলে প্রতিটি পাসপোর্টে ১০০ থেকে ২০০ টাকা করে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যাত্রীরা বলছেন, টাকা না দিলে ব্যাগ খুলে তছতছ করা হচ্ছে। পুলিশের হাতে ১০০ টাকা গুজে দিলেই ছেড়ে দেওয়া হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, ইমিগ্রেশনের স্ক্যানার যন্ত্রে ব্যাগ তল্লাশির পর বাইরে বের হওয়ার পথে লাইনে দাঁড় করিয়ে যাত্রীদের পাসপোর্ট ও ব্যাগ তল্লাশি করছেন কয়েকজন পুলিশ সদস্য। ব্যাগ একটু বড় হলে ২০০ আর ছোট হলে ১০০ টাকা করে যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করছেন পুলিশ সদস্যরা। সেখানে একজন নারী যাত্রী বলেন, ‘ব্যবহারের জন্য ভারত থেকে একটা কম্বল, কিছু খাদ্যদ্রব্য ও কয়েকটি পোশাক কিনেছি। এতে ব্যাগ একটু বড় হয়ে গেছে। লাইনে দাঁড় করিয়ে পাসপোর্ট ও ব্যাগ চেক করছে পুলিশ। ব্যাগ খুলে যাতে এলোমেলো না করে, এ জন্য ১০০ টাকা পুলিশের হাতে দিয়েছি।’
একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন ভারত থেকে ফেরা নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা রবিউল রনি। তিনি বলেন, ‘আমরা চারজন মিলে চিকিৎসা ও ভ্রমণের জন্য ভারতে গিয়েছিলাম। ফেরার পথে ইমিগ্রেশনে সাদাপোশাকে কয়েকজন আমাদের ডেকে ২০০ করে টাকা দাবি করে। আমি বললাম, “স্যার, আমার কাছে বাংলা কোনো টাকা নেই। শুধু ভারতীয় ৫০ রুপি আছে।” তারা বলল, “সেটাই দেন।” শেষে ৫০ রুপি দিয়েই আমি ছাড়া পেয়েছি। আমার সঙ্গে থাকা একজন ১০০ টাকা দিতে বাধ্য হন। অন্য দুজন দালালদের ডাকে সাড়া না দিয়ে কৌশলে তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যান।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ইমিগ্রেশন পুলিশ বেনাপোলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইমতিয়াজ মো. আহসানুল কাদের ভূঞা প্রথম আলোকে বলেন, ইমিগ্রেশনে প্রবেশের সময় বিদেশি নাগরিকদের ক্ষেত্রে এমবারকেশন কার্ড পূরণ করার নিয়ম রয়েছে। যেটি যাত্রীর নিজের পূরণ করার কথা। এখানে টাকাপয়সা লেনদেনের কোনো প্রশ্ন নেই। যাত্রীদের কাছ থেকে পুলিশ সদস্য ও দালালদের টাকা আদায় করার কথা নয়। তারপরও অভিযোগটি তিনি খতিয়ে দেখবেন।
ইমিগ্রেশন সূত্রে জানা গেছে, গত রোববার এই বন্দর দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে এসেছেন ১ হাজার ৯১৩ জন এবং বাংলাদেশ থেকে ভারতে গেছেন ১ হাজার ৭০ জন। এখন প্রতিদিন গড়ে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার মানুষ দুই দেশের মধ্যে যাতায়াত করছেন। গত ৫ আগস্টের আগে এই সংখ্যা ছিল প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ হাজার। ভারত সরকার ভ্রমণ ভিসা দেওয়া বন্ধ করায় দুই দেশের মধ্যে গমনাগমন এখন এক–তৃতীয়াংশে নেমেছে।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যাতায়াতের সময় যাত্রীদের পাঁচ দফায় তল্লাশির মুখোমুখি হতে হয়। যে কারণে যাত্রীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
গত রোববার সরেজমিনে দেখা গেছে, শূন্যরেখা থেকে প্রবেশের মুখে বিজিবির স্ক্যানার যন্ত্রে প্রথম দফায় ব্যাগ তল্লাশি করা হয়। এরপর কাগজপত্র যাচাই–বাছাইয়ের পর পাসপোর্টে সিল দিয়ে ইমিগ্রশন বিভাগের স্ক্যানার যন্ত্রে দ্বিতীয় দফায় ব্যাগ তল্লাশি হয়। এরপর তৃতীয় দফায় ইমিগ্রেশন পুলিশ সদস্যরা পাসপোর্ট ও ব্যাগ তল্লাশি করেন। চতুর্থ দফায় প্যাসেনজার টার্মিনালের বাইরে বের হওয়ার মুখে টেবিলের ওপরে ব্যাগের জিনিসপত্র নামিয়ে বিজিবি সদস্যরা তল্লাশি চালান। যাত্রীরা যানবাহনে চড়ে বেনাপোল ছেড়ে যাওয়ার সময় আট কিলোমিটারের মাথায় আমড়াখালী বাঁশকলে যানবাহন থামিয়ে পঞ্চম দফায় বিজিবির সদস্যরা আবার তল্লাশি চালান।
১৪ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বন্দর পরিদর্শনে গিয়ে অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন। সেখানে ভারত-বাংলাদেশ চেম্বারের পরিচালক মতিয়ার রহমান তল্লাশির নামে হয়রানির অভিযোগ তুলে ধরেন। তখন উপদেষ্টা তল্লাশি সহনশীল পর্যায়ে রাখার বিষয়ে বিজিবি ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন। কিন্তু ১১ দিন পেরিয়ে গেলেও অবস্থার উন্নতি হয়নি।
এ বিষয়ে বেনাপোল কাস্টম হাউসের কমিশনার কামরুজ্জামান বলেন, ইমিগ্রেশনে কাস্টমস বিভাগের তল্লাশির আইনগত বৈধতা রয়েছে। কিন্তু বিজিবির ইমিগ্রেশনে তল্লাশির আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। এখতিয়ারবহির্ভূত তল্লাশিচৌকি বসিয়ে যাত্রীদের তল্লাশি করে তারা। উপদেষ্টা মহোদয় তাগিদ নেওয়ার পরও বিজিবি ইমিগ্রেশনে তল্লাশি বন্ধ করেনি।
তবে ৪৯ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী বলেন, সীমান্তে চোরাচালান রোধে ইমিগ্রেশনে তল্লাশি করা হয়। এ ছাড়া পুটখালী সীমান্ত থেকে অনেকে চোরাচালানি পণ্য নিয়ে যশোর শহরের দিকে যায়। এ জন্য আমড়াখালীতে গাড়ি থামিয়ে আরেক দফায় তল্লাশি করা হয়। তল্লাশিতে আরও সহনশীল হওয়ার বিষয়টি তাঁরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন।
১৪ নভেম্বর নৌপরিবহন উপদেষ্টা সাখাওয়াত হোসেন স্থলবন্দর পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ের বলেছিলেন, বেনাপোল ইমিগ্রেশনে যাত্রীদের ব্যাগ তল্লাশির জন্য অন্তত দুটো স্ক্যানার মেশিন থাকা দরকার। সেখানে আছে একটি। অপর মেশিনটি দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে কাস্টম হাউসের কমিশনার কামরুজ্জামানকে ডেকে বলেন, ‘আপনি কাল সকালে ঢাকায় গিয়ে বসে থেকে স্ক্যানার মেশিনটি ঠিক করে বেনাপোলে ফিরবেন।’ তবে সেই নির্দেশের ১১ দিন পেরিয়ে গেলেও স্ক্যানার যন্ত্রটি ঠিক হয়নি।
এ বিষয়ে কাস্টমস কমিশনার মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘যন্ত্রটি মেরামতের জন্য যেসব যন্ত্রপাতি প্রয়োজন, তা চায়না থেকে আনার প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে।’