স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছেন গ্রামের লোকজন। গত রোববার খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার মাগুরাঘোন ইউনিয়নের ঘোষড়া গ্রামে
স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছেন গ্রামের লোকজন। গত রোববার খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার মাগুরাঘোন ইউনিয়নের ঘোষড়া গ্রামে

একটি মৃত্যু বদলে দিল গ্রামের জলাবদ্ধতা, স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত হলো সড়ক

প্রায় দুই মাস আগে মারা যান ষাটোর্ধ্ব জামাল সরদার। তখন গ্রামের চারদিকে শুধু পানি আর পানি। তাঁকে কবর দেওয়ার জন্য শুকনো জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না। গ্রামের সবাই মিলে রাস্তার ধারে বালু ফেলে উচু করে সেখানে দাফন করা হয় জামাল সরদারকে।

ঘটনাটি এলাকার মানুষের মনে ব্যাপক ‘দাগ কাটে’। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেন জলাবদ্ধতা থেকে গ্রামকে রক্ষা করার। যে ভাবা, সেই কাজ। জলাবদ্ধতা থেকে গ্রামকে বাঁচাতে হলে নিচু মাটির সড়ককে বাঁধের মতো করে উঁচু করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন প্রচুর টাকার। গ্রামের মানুষ কারও কাছে হাত না পেতে নিজেরাই এগিয়ে আসেন সড়ক উঁচু করার কাজে। গ্রামবাসীর টাকা ও স্বেচ্ছাশ্রমে দেড় মাসে নির্মিত হয়েছে চার ফুট উচু সড়ক। প্রায় দুই কিলোমিটার সড়কটির নির্মাণকাজ এখনো চলমান; তবে চারদিকের পানি আটকানো হয়েছে।

এ ঘটনা খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার মাগুরাঘোন ইউনিয়নের ঘোষড়া গ্রামের। ওই গ্রামের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে সাতক্ষীরার তালা উপজেলার সীমান্ত ও উত্তর পাশে যশোরের কেশবপুর উপজেলার সীমান্ত। গ্রামটি তুলনামূলকভাবে কিছুটা নিচু হওয়ায় তালা, কেশবপুরসহ আশপাশের বিভিন্ন জায়গার পানি এসে জমা হয় ওই গ্রামে। ছোট ওই গ্রামে তিন শতাধিক পরিবার বসবাস করে। ভোটার রয়েছেন এক হাজারের মতো।

গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ঘোষড়া-বাদুড়িয়া কাটাখাল। খালটি গিয়ে মিলেছে ডুমুরিয়ার নরনিয়া এলাকার ভদ্রা নদীতে। নদীর মুখে চার ভেন্টের জলকপাট রয়েছে। পলি পড়ে ভদ্রা নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় খাল দিয়ে পানি সরতে পারছে না। এ কারণে খাল উপচে গ্রামের মধ্যে পানি ঢুকে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় তিন মাস জলাবদ্ধ অবস্থায় কাটিয়েছেন তাঁরা। রাস্তা উচু করে বাঁধের মতো করে দেওয়ায় এখন আর গ্রামের মধ্যে পানি ঢুকতে পারছে না। গ্রামের মধ্যে যে পানি আটকে আছে, তা–ও ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। এ কারণে এলাকার মানুষ আশপাশের অন্যান্য গ্রামের তুলনায় কিছুটা স্বস্তিতে রয়েছেন।

বিভিন্ন দপ্তরে সড়কটি উঁচু করে নির্মাণ করার জন্য আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো দপ্তরই সেই কাজে সাড়া দেয়নি। পরে নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে সড়ক তৈরি করে ফেলেছি।
হামিদুর রহমান মোড়ল, ঘোষড়া গ্রামের বাসিন্দা

গ্রামের বয়োবৃদ্ধ ওয়াজেদ আলী খান (৮২) ওই কাজের কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নিজে কাজ করতে না পারলেও প্রতিদিন সড়ক নির্মাণকাজের স্থানে গিয়ে বসে থেকে অন্যদের উৎসাহ দিতেন। গত রোববার দুপুরেও কাজের স্থানে পাওয়া গেল তাঁকে। সেখানেই কথা হয় ওয়াজেদ আলী খানের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার জীবনে এই এলাকায় এত বড় জলাবদ্ধতা আমি কখনো দেখিনি। বন্যার সময়ে আমাদের গ্রামের দুজন বয়স্ক ব্যক্তি মারা যান। সর্বশেষ জামাল সরদার মারা যাওয়ায় তাঁর দাফন নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়। গ্রামের কোথাও একটু শুকনো জায়গা ছিল না। তখন আমরা বাইরে থেকে বালু কিনে এনে একটি রাস্তার পাশে উঁচু জায়গা বানিয়ে তাঁকে দাফন করি। এরপর সিদ্ধান্ত নিই জলাবদ্ধতা নিরসনে কিছু একটা করতে হবে। সেই চিন্তা থেকেই নিজেরা চেষ্টা করে উঁচু রাস্তা তৈরি করছি।’

গ্রামের বাসিন্দা হামিদুর রহমান মোড়ল বলেন, ‘উপজেলা প্রশাসন, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্যসহ বিভিন্ন দপ্তরে সড়কটি উঁচু করে নির্মাণ করার জন্য আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো দপ্তরই সেই কাজে সাড়া দেয়নি। পরে নিজেরাই উদ্যোগ নিয়ে সড়ক তৈরি করে ফেলেছি। প্রতি বাড়ি থেকে প্রতিদিন একজন করে শ্রম দিতেন। সবার সম্মিলিত চেষ্টাতেই সড়ক যেমন উঁচু করা সম্ভব হয়েছে, তেমনি গ্রামের মধ্যে পানি প্রবেশ বন্ধ করা গেছে। এই সড়ক নির্মাণ করতে গিয়ে আশপাশের অনেক মাছের ঘের ব্যবসায়ী বাধা দিয়েছিলেন। কিন্তু সব বাধা অতিক্রম করে আমরা সড়ক নির্মাণ করতে সফল হয়েছি। গ্রামের মানুষ সবাই এক ছিল বলেই এমনটা সম্ভব হয়েছে।’

রাস্তা উচু করে বাঁধের মতো করে দেওয়ায় এখন আর গ্রামের মধ্যে পানি প্রবেশ করতে পারছে না

সড়ক নির্মাণকাজের সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে আছেন মাহবুবুর রহমান গাজী। তিনি ওই ইউপির সাবেক সদস্য। মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সড়ক নির্মাণে প্রায় ৫ লাখ টাকার পলিথিন, নেট, তার, দঁড়ি ও বালু তুলতে খরচ হয়েছে। এলাকার সবাই মিলে সেই টাকা দিয়েছেন। সড়ক নির্মাণকাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অংশ নিয়েছিলেন। ওই সড়ক টিকিয়ে রাখতে হলে দুই পাশে পাইলিং ও মাটি দিয়ে স্ল্যাব করা প্রয়োজন। চলাচলের জন্য ইটের সলিংও দেওয়া দরকার। সড়ক নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ। সরকার থেকে সামান্য বরাদ্দ দিলেই সড়কটি টেকসই করে রাখা যাবে।

সড়ক নির্মাণের সময় ডুমুরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ আল-আমিন সেখানে গিয়েছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই কাজ করার সময় প্রশাসনের পক্ষ থেকে গ্রামবাসীকে উৎসাহিত করা হয়েছে। কারণ, দুর্যোগের সময় যদি সবাই স্বেচ্ছাশ্রম না দেয়, সবাইকে সম্পৃক্ত করা না যায়, তাহলে দুর্যোগ মোকাবিলা করা কঠিন।’ তিনি আরও বলেন, সড়কটি টেকসই রাখতে এলাকাবাসী পাইলিং করার দাবি জানিয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেই কাজ করে দেওয়া হবে।