গত মার্চে চালু হয়েছে দেশের প্রথম ধান জাদুঘর। বিভিন্ন জাতের ধানের পাশাপাশি দেখা যাবে ধানভিত্তিক সংস্কৃতির রূপান্তর।
ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি ও জাত উন্নয়নে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) যাত্রা শুরু হয়েছিল সত্তরের দশকে। শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠানটি একের পর এক নতুন জাতের ধান কৃষকদের উপহার দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবিত ১০৮ জাতের মধ্যে কোনোটি উচ্চ ফলনশীল জাত, কোনোটি লবণ, খরা কিংবা বন্যাসহিষ্ণু। কোনো জাত জনপ্রিয়তা পেয়েছে কৃষক পর্যায়ে, কোনোটি আবার ভূমিকা রেখেছে গবেষণায়। এই সব জাতের ধান একসঙ্গে দেখা যাবে দেশের প্রথম ‘রাইস মিউজিয়াম’ বা ধান জাদুঘরে।
শুধু বিভিন্ন জাতের ধানই নয়, দেশের ধান চাষের ঐতিহ্য ও কৃষিপ্রযুক্তির রূপান্তরের একটি চিত্রও পাওয়া যাবে গাজীপুরে ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে প্রতিষ্ঠিত এই জাদুঘরে। ২০১৮ সালে জাদুঘরটি স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছিল। কাজ শেষে গত ১২ মার্চ দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে।
ব্রির প্রতিষ্ঠা ১৯৭০ সালে। প্রতিষ্ঠানটির প্রথম উদ্ভাবিত ধানের জাত ছিল বিআর-১ (চান্দিনা)। প্রতিষ্ঠানটি বিআর-২৮, বিআর–২৯, বঙ্গবন্ধু ধান-১০০ সহ মোট ১০৮টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। গত পাঁচ দশকের পথচলায় প্রতিষ্ঠানটি পেয়েছে স্বাধীনতা পুরস্কার। সর্বশেষ চলতি বছর বিআর ধান-৮৯ উদ্ভাবন করে ইনস্টিটিউটের তিন বিজ্ঞানী পেয়েছেন একুশে পদক।
এই পাঁচ দশকে দেশের ধান চাষে ঘটেছে নানা রূপান্তর। গরু দিয়ে হালচাষের বদলে এসেছে কলের লাঙল। বীজ বপন, আগাছা দমন, ধান কাটা ও মাড়াই—সবখানে লেগেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। দেশের ধানভিত্তিক অর্থনীতির এই বিবর্তন তুলে ধরা হয়েছে জাদুঘরটিতে।
ইনস্টিটিউটের প্রধান ফটক দিয়ে কিছু দূর এগোলেই চোখে পড়ে ‘বিআরআরআই রাইস মিউজিয়াম’। এর ফটকে বড় একটি ধানের ছবি লাগানো। ভেতরে বাঁ দিকে রেপ্লিকার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে ধান চাষের শুরু থেকে কৃষকের ঘরে তোলা পর্যন্ত সব কটি ধাপ। এরপর ব্রির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত উদ্ভাবিত ১০৮টি ধানের জাত তাকে তাকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ধানের বিভিন্ন রোগ ও ক্ষতির নমুনা, ধান চাষে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, ব্রি উদ্ভাবিত যন্ত্রপাতির রেপ্লিকা, ধানভিত্তিক ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দেখা মিলবে এখানে। পুরো জাদুঘর তৈরি করা হয়েছে ধানের আদলে। এক পাশে আছে বসার স্থান ও পরিদর্শন বই।
প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্রি উদ্ভাবিত নতুন জাতের প্রদর্শনীর পাশাপাশি এ জাদুঘরের মাধ্যমে আধুনিক ধানবিষয়ক কৃষিপ্রযুক্তি দেশি-বিদেশি পরিদর্শকদের জন্য তুলে ধরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ধানের জাত ও প্রযুক্তিগুলোর নমুনা ও রেপ্লিকা স্থাপন করা হয়েছে। মিউজিয়ামে প্রদর্শনী তাকে নতুন ও পুরোনো কৃষি যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে। এর ফলে দেশ–বিদেশ থেকে আসা বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থী ও গবেষকেরা এখানে এসে ধান সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে যাচ্ছেন। দেশে উদ্ভাবিত ধানের জাতগুলো তাঁরা দেখতে পারছেন।
জাদুঘর প্রকল্পের পরিচালক আবদুল মোমিন প্রথম আলোকে বলেন, গত ৫০ বছরে ব্রি মোট ১০৮টি ধানের জাত উদ্ভাবন করেছে। আগে কাউকে একসঙ্গে এতগুলো জাত দেখানো যেত না। কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় সব কটি জাত এই জাদুঘরে রাখা হয়েছে। এখন যে কেউ এসে একসঙ্গে সব জাত দেখতে পারছেন।
প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা জানান, প্রতিবছর লাখ লাখ দেশি-বিদেশি পর্যটক, বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কৃষকেরা ব্রি পরিদর্শনে আসেন। তাঁরা ব্রির অগ্রগতির ইতিহাস ও সার্বিক কর্মকাণ্ড একনজরে দেখতে চান। আন্তর্জাতিক মানের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও ব্রিতে এর আগে কোনো সুসজ্জিত জাদুঘর না থাকায় সবাই পরিদর্শনে এসে হতাশ হতেন। তাই এই দেশের ধান গবেষণার অতীত ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধানভিত্তিক আচার–অনুষ্ঠান ও সংস্কৃতি এবং খাদ্যনিরাপত্তায় ব্রি তথা বাংলাদেশ সরকারের সাফল্য তুলে ধরার জন্য অত্যাধুনিক জাদুঘরটি স্থাপন করা হয়।