একমাত্র সি ট্রাক বিকল, ট্রলার–স্পিডবোটে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল

গত ১৫ মার্চ সি ট্রাক চালুর পর সাত-আট দিন চলেই বিকল হয়ে পড়ে। সেই থেকে সি ট্রাক আর চলেনি। এই সময়ে লঞ্চও চলছে না।

মনপুরা-তজুমদ্দিন নৌপথে অবৈধ ট্রলারে চলছে যাত্রী পারাপার। যেকোনো মুহূর্তে বড় নৌ দুর্ঘটনা ঘটার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। গত সোমবার।

দ্বীপজেলা ভোলার একটি উপজেলা মনপুরা। এটি এ জেলার সবচেয়ে বড় দ্বীপ। এই উপজেলা থেকে মূল ভূখণ্ডে আসতে মনপুরা-তজুমদ্দিন নৌপথে চলাচল করে একটিমাত্র বৈধ নৌযান সি ট্রাক ‘আব্দুর রব সেরনিয়াবাত’। সেই সি ট্রাকটি গত এক মাস ধরে বিকল হয়ে পড়ে রয়েছে। সি ট্রাকটি না থাকায় মনপুরাবাসীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রলার ও স্পিডবোটে চলাচল করতে হচ্ছে। এতে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) সূত্রে জানা যায়, ১৫ মার্চ থেকে ১৫ অক্টোবর—এ ৮ মাস সাগর উত্তাল থাকার কারণে সমুদ্র আইনে মনপুরা-তজুমদ্দিন নৌপথে সি ট্রাক ছাড়া অন্য নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাকি সময় লঞ্চ চলতে পারবে। যদিও সি ট্রাকের ইজারাদারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, সারা বছরই সি ট্রাকটি চালু রাখার কথা।

স্থানীয় লোকজন জানান, ২০২১ সালে মার্চের পর একটানা ৬ মাস বন্ধ ছিল সি-ট্রাক। তখন ইজারাদার লঞ্চ চালিয়েছেন। ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত লঞ্চ চলেছে। এরপর নিয়ম অনুযায়ী ১৫ মার্চ থেকে সি ট্রাক চালু করা হয়। কিন্তু এবার সাত-আট দিন চলেই সি ট্রাক বিকল হয়ে পড়ে। সেই থেকে সি ট্রাক আর চালু হয়নি। এই সময়ে লঞ্চও চলছে না। ভোলা সদরসহ অন্যান্য উপজেলায় যেতে ট্রলার আর স্পিডবোটই তাঁদের শেষ ভরসা। অথচ এ দুটি যানই অবৈধ। সাগরের এই উত্তাল সময়ে যখন লঞ্চ চলাচলই নিষিদ্ধ, তখন মানুষজন ট্রলার-স্পিডবোটে চলাচল করতে বাধ্য হচ্ছেন। সি ট্রাকে প্রতিদিন পাঁচ শতাধিক যাত্রী যাতায়াত করেন। সি ট্রাক থাকুক বা না থাকুক, প্রতিদিন মনপুরা-তজুমদ্দিন নৌপথে দুই হাজার যাত্রী চলাচল করে।  

কিছু দিন পরেই ঈদুল ফিতর। এই সময় কালবৈশাখীও হয়। ঈদে নৌপথে মানুষের চলাচল বেড়ে যায়। এতে যেকোনো মুহূর্তে বড় ধরনের নৌ-দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় কে নেবে, এমন প্রশ্নের জবাবে ভোলায় কর্মরত বিআইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা পরিদর্শক (টিআই) মো. জাহিদুল ইসলাম, মনপুরা উপজেলার ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও চরফ্যাশনের ইউএনও মো. আল নোমান এবং তজুমদ্দিনের ইউএনও মরিয়ম বেগম বলেন, তাঁরা বিষয়টি জানেন না। খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেবেন।

দ্বীপের বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, সি ট্রাকের ইজারাদার সি ট্রাকের মাস্টারের সঙ্গে যোগসাজশ করে ইচ্ছা করে সি ট্রাকটি বিকল দেখিয়ে ওই নৌপথে ট্রলার চালাচ্ছেন মালিকেরা। ট্রলারের যাত্রীদের ১৮০ টাকা করে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। অথচ সরকারি হিসাবে তজুমদ্দিন-মনপুরা-হাজিরহাট নৌপথের ২২ কিলোমিটারের ভাড়া ৬৩ টাকা।

প্রশাসনেরও একটি সূত্র জানায়, অনুন্নত যোগাযোগের কারণে উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী মনপুরায় আসতে চান না। বর্তমানে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পদসহ সরকারি বেশির ভাগ পদ শূন্য রয়েছে। ফলে সরকারি সেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন মনপুরার মানুষজন। ভালো সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় এই উপজেলায় পর্যটনশিল্পেরও বিকাশ হচ্ছে না।

গত সোমবার সরেজমিনে দেখা যায়, বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষা মনপুরা দ্বীপটির চারপাশেই মেঘনা নদী। মানুষজন অবৈধ ট্রলারে করে ভোলা সদরে চলাচল করছেন। চলছে স্পিডবোটও।

মনপুরা থেকে ভোলা সদর উপজেলার দূরত্ব প্রায় ৮০ কিলোমিটার। জলপথে বৈধভাবে মনপুরা থেকে মূল ভূখণ্ডে আসার মাত্র দুটি পথ। একটি মনপুরা-তজুমদ্দিন নৌপথ। অন্যটি ঢাকা-ভোলা-মনপুরা-হাতিয়া নৌপথ। ঢাকা-ভোলা-মনপুরা-হাতিয়া নৌপথে দুটি লঞ্চ চলে। স্থানীয় লোকজন জানান, এই পথের প্রধান অসুবিধা নদীতে অতিরিক্ত সময় লাগে। জেলা শহরে দিনে দিনে কাজ সেরে ফিরে আসা যায় না। আর মনপুরা-তজুমদ্দিন নৌপথে ঋতুভেদে কিছুদিন চলে লঞ্চ, আর কিছুদিন চলে সি ট্রাক। কিন্তু যখনই ১৫ মার্চ আসে, তখন কয়েক দিন সি ট্রাক চলে আচমকা বিকল হয়ে যায়। তখন লঞ্চ তো চলেই না, চলতে থাকে সারা বছর নিষিদ্ধ ট্রলার। এ সমস্যা চলছে গত ১৫-১৬ বছর ধরে।

যাত্রীরা বলেন, এই নৌপথে একটা ভালো বিকল্প নৌযান হতে পারে ফেরি। নইলে উন্নতমানের লঞ্চ। অনেক দিন থেকেই মনপুরা-চরফ্যাশন নৌপথে একটি ফেরি সার্ভিস চালুর দাবি করে আসছেন স্থানীয় জনগণ ও উপজেলা প্রশাসন। বিআইডব্লিউটিএর একটি দল ২০২২ সালে সরেজমিন পরিদর্শন করে গেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। ফলে প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে মনপুরাবাসী ও সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, চিকিৎসক, প্রকৌশলী এসব অবৈধ যানবাহনে মূল ভূখণ্ডে যাতায়াত করছেন।

মনপুরা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের হিসাবরক্ষক মাহমুদুল হাসান বলেন, সি ট্রাকের অভাবে জরুরি রোগীদের অবৈধ ট্রলার, নইলে স্পিডবোটে পাঠাতে হচ্ছে। এতে রোগীরা আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। অনেক রোগী এভাবে মারা যান। কারণ, ঢাকাগামী লঞ্চে উঠলে ভোলা পৌঁছাতে রোগীর প্রায় একদিন লেগে যায়।

সি ট্রাক কেন বন্ধ রেখেছেন জানতে চাইলে ইজারাদার নুরুদ্দিন শিকদার বলেন, ‘ইঞ্জিনের ত্রুটির কারণে সি ট্রাক বন্ধ রাখা হয়েছে। আসছে শুক্রবার নাগাদ চালু হবে। বেশি লাভের আশায় সি ট্রাকের পরিবর্তে ট্রলার চালানোর অভিযোগটি সত্য নয়।’

তবে সি ট্রাকের মাস্টার নুর হোসেন বলেন, সি ট্রাক ঠিক আছে, কিন্তু যাত্রী কম হওয়ায় সি ট্রাক বন্ধ রাখা হয়েছে। যদি ওই নৌপথে প্রশাসন অবৈধ ট্রলারে যাত্রী পারাপার বন্ধ রাখে, তাহলে সি ট্রাকে যাত্রী হবে।

 ভোলা নদীবন্দরের উপপরিচালক মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, ১৫ মার্চ থেকে ১৫ অক্টোবর—এ ৮ মাস ভোলার ইলিশা থেকে দক্ষিণের সাগরমোহনা পর্যন্ত নদীগুলো সাগরের মতো বিপজ্জনক জলসীমানায় (ডেঞ্জার জোন) পরিণত হয়। সমুদ্র আইনে এ সময় সি ট্রাক বা সিসার্ভে সনদধারী লঞ্চ ছাড়া অন্য নৌযান চলাচল নিষেধ ও বিপজ্জনক। কিন্তু যাত্রীরা বাধ্য হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রলার–স্পিডবোটে চলছে। সমস্যাটি সমাধানে তিনি প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে চিঠি দিয়েছেন। তারপরও ট্রলারে যাত্রী বহন হচ্ছে।