নাগরিকত্ব না পেলে মিয়ানমার ফিরে যাব না, মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলকে রোহিঙ্গারা

মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাতের অপেক্ষায় একটি রোহিঙ্গা পরিবার। বুধবার দুপুরে টেকনাফ স্থলবন্দরের ট্রানজিট কেন্দ্র
ছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজারের টেকনাফে আসা মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদলের সদস্যদের অনেক রোহিঙ্গা নারী–পুরুষ বলেছেন, নাগরিকত্ব না পেলে তাঁরা মিয়ানমারে ফিরে যাবেন না। আজ বুধবার রাত পৌনে আটটা পর্যন্ত ২৯ পরিবারের ৯৩ জন রোহিঙ্গা নারী–পুরুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছে প্রতিনিধিদলটি।

মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আজ বুধবার সকাল থেকে টেকনাফ স্থলবন্দরে অপেক্ষায় ছিলেন রোহিঙ্গা হোসেন জোহার (৬০), তাঁর দুই স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে। তিনি আরও ১৫ ছেলেমেয়েকে নোয়াখালীর ভাসানচর আশ্রয়শিবিরে রেখে এসেছেন।

হোসেন জোহার প্রথম আলোকে বলেন, ২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি উখিয়ার আশ্রয়শিবির থেকে তিনি দুই স্ত্রী ও ১৭ ছেলেমেয়ে নিয়ে ভাসানচর আশ্রয় শিবিরে ঠাঁই নেন। মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য দুই দিন আগে তাঁদের ভাসানচর থেকে টেকনাফে আনা হয়।

আজ দুপুরে মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন হোসেন জোহার। এরপর তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা যে মিয়ানমারের নাগরিক, এর সপক্ষে অনেক তথ্য যাছাই-বাছাই হয়েছে। সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। জানিয়ে এসেছেন, শুধু তথ্য যাছাই-বাছাই করলে হবে না, তাঁদের ফিরিয়ে নিতে হলে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দিতে হবে। না হলে রাখাইন রাজ্যে ফিরে যাবেন না।

২২ সদস্যের মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলটি বুধবার সকালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহর থেকে নৌযানে নাফ নদী অতিক্রম করে টেকনাফ পৌঁছান। এর নেতৃত্বে আছেন মিয়ানমারের মিনিস্ট্রি অব ফরেন অ্যাফেয়ার্সের মংডুর আঞ্চলিক পরিচালক অং মাইউ। টেকনাফে দলটিকে অভ্যর্থনা জানান কক্সবাজারস্থ শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মুহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা।

এরপর আজ বেলা ১১টার দিকে টেকনাফ স্থলবন্দরের অভ্যন্তরে মালঞ্চ সম্মেলনকক্ষে মিয়ানমার প্রতিনিধিদল ও বাংলাদেশের একটি দলের যৌথ উদ্যোগে কক্সবাজারের বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার এবং তথ্য যাছাই শুরু হয়।

প্রত্যাবাসনের জন্য তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের তথ্য যাচাইয়ে কক্সবাজারের টেকনাফে মিয়ানমারের ২২ সদস্যের প্রতিনিধিদল। বুধবার সকালে

আরআরআরসি কার্যালয় সূত্র জানায়, চীনের মধ্যস্থতায় ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তখন প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ থেকে যে আট লাখ রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারে পাঠানো হয়েছিল, এর থেকে প্রথম ধাপে ১ হাজার ১৪০ জনকে নেওয়ার জন্য কথা বলা হয়েছিল।

এ তালিকার ৭১১ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সম্মতি পাওয়া গিয়েছিল। অবশিষ্ট ৪২৯ জনের বিষয়ে মিয়ানমারের অপত্তি ছিল। বাংলাদেশ সরকারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে, মিয়ানমারের প্রতিনিধিদলটি টেকনাফে এসেছে ৪২৯ জন রোহিঙ্গার তথ্য যাছাইয়ে।

তথ্য যাছাইয়ের পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে জানিয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিনিধিদলটি টেকনাফ এসেছে মূলত প্রথম ধাপে প্রত্যাবাসনের জন্য তালিকাভুক্ত ৪২৯ জন রোহিঙ্গার তথ্য যাছাই–বাছাই করতে। এ ছাড়া তালিকাভুক্ত এসব রোহিঙ্গা পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুদেরও ডেটাবেজ তৈরি করছে দলটি। প্রতিদিন ৬০ থেকে ১০০ জন রোহিঙ্গার তথ্য যাছাই করা হবে। এ ক্ষেত্রে ৪২৯ জনের তথ্য যাছাই করতে পাঁচ-ছয় দিন সময় লেগে যেতে পারে। তত দিন মিয়ানমার দলটি টেকনাফে অবস্থান করবে।

প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য রোহিঙ্গা নারী নাছিমা বেগম (৪৪) ও আমিন হোসেনও (৪৫) এসেছেন ভাসানচর আশ্রয়শিবির থেকে। আমিন হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ভাসানচরে স্থানান্তর হওয়ার আগে তাঁর নামের তালিকা মিয়ানমার সরকারের কাছে পাঠানো হয়। নাগরিকত্বসহ রাখাইন রাজ্যে তাঁদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনভাবে চলাফেরার সুযোগ দেওয়া হলে মিয়ানমারে ফিরতে রাজি হবেন।

বিকেলে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন টেকনাফের লেদা আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা আলী আহমদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিনিধিদলের সদস্যরা আমাকে প্রথমে সামনাসামনি চেয়ারে বসিয়ে নানা জেরা শুরু করেন। একজন মিয়ানমার থেকে কখন এসেছি জানতে চান। আরেকজন জানতে চান, মংডু ওক্কাটা (ইউনিয়নের চেয়ারম্যান) কে? আরেকজন জানতে চান, তখন সরকারপ্রধান কে ছিলেন। সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার পর দলের সদস্যরা একটি কাগজে আমার টিপসই নেন।’

সরেজমিনে দেখা যায়, টেকনাফ স্থলবন্দরে একটি ভবনের সামনের মাঠে একটি প্যান্ডেলের নিচে বসানো হয়েছে টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয়শিবির থেকে নিয়ে আসা শতাধিক রোহিঙ্গাকে। সেখান থেকে তথ্য যাছাইয়ের জন্য একজন একজন করে রোহিঙ্গাদের ডেকে নেওয়া হচ্ছে প্রতিনিধিদলের কাছে। সাক্ষাৎকার শেষে রোহিঙ্গাদের বাসে তুলে টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে ফেরত পাঠানো হয়।

যেখানে বসে সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছিল, সেখানে গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশ সীমিত রাখা হয়। সাক্ষাৎকার নিয়ে বাংলাদেশের ও মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের কেউ কথা বলতে রাজি হননি।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বুধবার রাত পৌনে আটটা পর্যন্ত ২৯ পরিবারের ৯৩ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। আগামীকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে আরও ৭০ জনের বেশি রোহিঙ্গার তথ্য যাছাইয়ের কথা রয়েছে।

বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে আসা নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে আট লাখ এসেছে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর নিপীড়নের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর।