রান্নাঘরের মাটির চুলা নষ্ট হয়ে গেছে। খোলা আকাশের নিচে ধার করা মাটির চুলায় বসানো হয়েছে ভাত। বসতঘরের চারটিতে চালা থাকলেও তিনটির চারপাশে নেই কোনো বেড়া। সব আসবাব পানির তোড়ে ভেসে গেছে। এ রকম বসতবাড়ির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন শারমিন আক্তার। অথচ কয়েক দিন আগেও ছিল তাঁর সাজানো–গোছানো সংসার। বন্যায় সবকিছু তছনছ হয়ে গেছে।
শারমিন আক্তার ও মো. আসাদুল্লাহ দম্পতির বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার মোগড়া ইউনিয়নের আইড়ল এলাকায়। তাঁদের দুটি মেয়েসন্তান রয়েছে।
ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে গত ২১ ও ২২ আগস্ট আখাউড়ার মোগড়া ইউনিয়নের কর্নেল বাজার-লক্ষ্মীপুর সড়কের হাওড়া নদী–সংলগ্ন আইড়ল এলাকা এবং খলাপাড়া এলাকার কবরস্থান ও আশ্রয়ণ প্রকল্পের হাওড়া নদীর বাঁধ ভেঙে ৩৬ গ্রাম প্লাবিত হয়। পানিবন্দী হয়ে পড়েন প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ।
শারমিন আক্তার ও মো. আসাদুল্লাহ দম্পতি উপজেলার কর্নেল বাজার-লক্ষ্মীপুর সড়কের ভাঙা অংশের আইড়ল গ্রামের দক্ষিণ দিকের ঢালু জায়গার বাসিন্দা। একই বাড়িতে আসাদুল্লাহর বড় ভাই বাবু সরকার স্ত্রী তানিয়া আক্তার ও তিন সন্তানকে নিয়ে বসবাস করেন। বাবু ও আসাদুল্লাহ কৃষিকাজের পাশাপাশি দিনমজুরের কাজ করেন।
ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে গত ২১ ও ২২ আগস্ট আখাউড়ার মোগড়া ইউনিয়নের কর্নেল বাজার-লক্ষ্মীপুর সড়কের হাওড়া নদী–সংলগ্ন আইড়ল এলাকা এবং খলাপাড়া এলাকার কবরস্থান ও আশ্রয়ণ প্রকল্পের হাওড়া নদীর বাঁধ ভেঙে ৩৬ গ্রাম প্লাবিত হয়।
গতকাল বুধবার দুপুরে দিকে দেখা যায়, আইড়ল গ্রামের ভাঙা অংশের দক্ষিণ দিকে নিচের ঢালু জায়গায় চারটি বসতঘর। টিনের চালা থাকলেও তিনটি ঘরের চারপাশের কোনো বেড়া নেই। একটি ঘরের তিন দিকে বেড়া থাকলেও পূর্ব দিকের বেড়া ভাঙা। ওই ঘরে বাবু সরকার ও তাঁর স্ত্রী তানিয়া আক্তার খাবার খাচ্ছেন। বাড়ির পশ্চিম দিকে রান্নাঘরের দুটি মাটির চুলা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে আছে। রান্নাঘরের ওপর নড়বড়ে একটি চালা থাকলেও চারপাশে নেই কোনো বেড়া। সেখানে খোলা আকাশের নিচে আরেকটি মাটির চুলায় ভাত বসিয়েছেন শারমিন আক্তার।
উঠানে বসেই বন্যার ধ্বংসযজ্ঞ দেখাচ্ছিলেন আর আফসোস করছিলেন শারমিন। তিনি বলেন, ‘২১ আগস্ট সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বাড়ির চারপাশে বাঁধ দিয়েছি। কিন্তু ভোরে হঠাৎ সড়ক ভেঙে প্রচুর বেগে বাড়িতে পানি ঢুকতে থাকে। মুহূর্তের মধ্যেই চারটি ঘরের চারপাশের টিন, খাট, লেপ, তোষকসহ সব আসবাব ভেসে যায়। পরে রাস্তায় গিয়ে আশ্রয় নিই।’
কিছু টাকা পেয়েছি, তা দিয়েই রান্না হচ্ছে। স্বামীর আয়–রোজগার তেমন একটা নেই। কীভাবে ঘর মেরামত করব, জানি না। কত দিন এভাবে যে থাকতে হবে।শারমিন আক্তার, গৃহবধূ
শারমিন আক্তার বলেন, ‘প্রথম ৫ থেকে ৬ দিন দিনে বাড়িতে এবং রাতে পাশের চাচাশ্বশুর রফিকুল ইসলামের বাড়িতে থেকেছি। পানি কমে যাওয়ার পর রাতে ভাঙাচোরা ঘরে থাকছি। সংসার ও বাড়ির জন্য মায়া লাগে। বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাব? বন্যার পানিতে সব হারিয়েছি। রাতে ভয় পেয়ে কী হবে? হারানোর আর কিছু নেই। মাটির চুলাটাও ধার করে এনে রান্না করছি।’
শারমিন আক্তার আরও বলেন, ‘কিছু টাকা পেয়েছি, তা দিয়েই রান্না হচ্ছে। স্বামীর আয়–রোজগার তেমন একটা নেই। কীভাবে ঘর মেরামত করব, জানি না। কত দিন এভাবে যে থাকতে হবে। দুই বছর আগে বাঁধ ভাঙলেও বাড়িতে কিংবা উঠানে পানি ওঠেনি। এই প্রথম বাড়ি, উঠান ও বসতঘরে পানি ঢুকেছে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গাজালা পারভীন প্রথম আলোকে বলেন, বন্যায় উপজেলার ১ হাজার ৬৯৭টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইটনা, আইড়ল ও খলাপাড়ায় ৯টি বসতঘর বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের প্রত্যেককে তিন বান্ডিল করে টিন দিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানানো হয়েছে। এ ছাড়া বেসরকারি উদ্যোগে এখন পর্যন্ত খলাপাড়ার প্রত্যেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকা করে সহায়তা পেয়েছেন।