গাজীপুরের শ্রীপুরে পোশাক কারখানায় কাজ করতেন শামীম মিয়া (৩৫)। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তুঙ্গে উঠলে কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। তখন শামীম মিয়াও আন্দোলনে যোগ দেন। ৫ আগস্ট বাঁ পায়ের ঊরুতে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। জমিজমা বিক্রি করে তাঁর চিকিৎসা করছে পরিবার। এখন গ্রামের বাড়িতে শুয়ে শামীম মিয়ার দিন কাটছে। অর্থাভাবে তাঁর সুচিকিৎসা নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
শামীম মিয়ার বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইল পৌরসভার আমোদাবাদ কান্দাপাড়া মহল্লায়। বাবার নাম হাদিস মিয়া। স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে শামীম গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। স্বামী–স্ত্রী দুজনই ওই এলাকার একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। এখন দুই সন্তানকে নিয়ে আহত শামীম মিয়া নান্দাইলে আছেন। অন্যদিকে জীবিকার প্রয়োজনে তাঁর স্ত্রীকে গাজীপুরে ফিরে যেতে হয়েছে।
গতকাল শুক্রবার বেলা একটার দিকে নান্দাইল পৌরসভার আমোদাবাদ কান্দাপাড়া মহল্লায় গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির অন্ধকার একটি কক্ষে শুয়ে আছেন শামীম। তাঁর বাঁ ঊরুতে ব্যান্ডেজ বাঁধা। ঊরু থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত স্টিলের আংটা লাগানো। শামীম মিয়া জানান, প্রায় প্রতিদিন তাঁর ক্ষতস্থান পরিষ্কার (ড্রেসিং) করতে হয়। ড্রেসিং ও ওষুধ বাবদ দিনে দুই হাজার টাকা খরচ হচ্ছে।
একপর্যায়ে শামীম মিয়া জানান সেদিনের (৫ আগস্ট) কথা। শামীম মিয়া বলেন, ৫ আগস্ট তিনি ভাড়া বাসা থেকে বের হয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে যোগ দেন। তখন আকাশে হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছিল। নিচে পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলছিল। হঠাৎ তিনি বাঁ পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় অচেতন হয়ে পড়েন। জ্ঞান ফিরে সড়ক থেকে কোনোরকমে পাশের একটি গলিতে যান। সেখান থেকে ছাত্ররা তাঁকে উদ্ধার করে মাওনা এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে প্রচুর গুরুতর আহত রোগী ছিলেন। পরে ছাত্ররা তাঁকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। ওই হাসপাতাল থেকে তাঁকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে (জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান–নিটোর) নেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে অসংখ্য রোগী ছিলেন, ভালো চিকিৎসা হচ্ছিল না। পরে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন।
বাবা জমিজমা বেইচ্চা দুই লাখ টেহা জোগাড় কইরা পাডাইছিন। হেই টেহা দিয়া পাওয়ের চিকিস্যা করাইছি। পাওভা কোনোমতে রক্ষা পাইছে। অহন অক্ষম (বেকার) অবস্থায় বাড়িতে আছি।শামীম মিয়া, গুলিবিদ্ধ পোশাকশ্রমিক
শামীম মিয়া বলেন, ‘বাবা জমিজমা বেইচ্চা দুই লাখ টেহা জোগাড় কইরা পাডাইছিন। হেই টেহা দিয়া পাওয়ের চিকিস্যা করাইছি। পাওভা কোনোমতে রক্ষা পাইছে। অহন অক্ষম (বেকার) অবস্থায় বাড়িতে আছি। পইতেক দিন দুই হাজার টেহার ওষুইদ লাগে। কিছুদিন আগেও আমি কামাই সুদ আছলাম। অহন বেহার অবস্থায় দিন কাটতাছে। দুই পোলাপানরে গ্রামের বাড়িত রাইখ্যা বউ কারহানাত (কারখানা) কাম করতো গেছে।’
শামীম মিয়া আরও বলেন, ‘টিভিতে দেখেছি, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হতাহতদের আর্থিকভাবে সহায়তা করা অইব। আমি তো ছাত্রদের লগে আন্দোলনে গিয়া পুলিশের গুলিতে আহত অইছি। আমার নামটা যদি আফনেরা (সাংবাদিক) তালিকায় উডাইয়া দেইন, তোইলে আমার উফহার অইব।’
আহত ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন হাদিস মিয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সংসারে তিনিই (শামীম) কর্মক্ষম ছিলেন। তিনি ছাত্রদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। দেশের পরিবর্তন এসেছে; কিন্তু গুরুতর আহত ও বেকার অবস্থায় তাঁর ছেলের দিন কাটছে। চিকিৎসা করাতে গিয়ে জমিজমা বিক্রি করতে হয়েছে। সরকারি সহায়তা না পেলে সামনে ছেলের বাকি চিকিৎসা করা সম্ভব হবে না। ছেলেটি সুস্থ না হলে তাঁদের পরিবার একেবারে পথে বসবে।