গাইবান্ধা শহরের ডিবি রোডের ব্যস্ততম জিরো পয়েন্ট। সড়কের পাশে পুলিশ ক্যাফে ঘেঁষে সাজানো স্টল। ওপরে সুসজ্জিত কাপড়ের ছাউনি। পাশেই টানানো মূল্যতালিকা। সামনে নারী-পুরুষের ভিড়। পেছনের একটা প্ল্যাকার্ডে হাতে লেখা ‘প্রফিট ফ্রি অ্যান্ড ওপেন টু অল’ (অলাভজনক ও সবার জন্য উন্মুক্ত)। নিচে লেখা স্টুডেন্ট (ছাত্র)।
পথচারীরা সবাই ইংরেজি না বুঝলেও কম দামে শাকসবজি পাওয়ার বিষয়টি আঁচ করতে পারছেন। তাই ভিড় করে বিভিন্ন ধরনের সবজি কিনছেন। জেলা প্রশাসকের সহায়তায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের গাইবান্ধার শিক্ষার্থীরা এই জনতার বাজার গড়ে তুলেছেন। জেলা প্রশাসন থেকে সুদমুক্ত এক লাখ টাকা দিয়ে এ কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
উদ্যোক্তারা জানান, গত ৩০ অক্টোবর সকালে গাইবান্ধায় জনতার বাজারের উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক চৌধুরী মোয়াজ্জম আহমদ। প্রতিদিন ৮০০ থেকে ১ হাজার কেজি (১ টন) সবজি বিক্রি হচ্ছে। সবজির দাম স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এটি চলমান থাকবে।
জেলা প্রশাসক চৌধুরী মোয়াজ্জম আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণ মানুষ যাতে কম দামে সবজি কিনতে পারেন, সে জন্য শিক্ষার্থীদের এমন বাজার গড়ে তুলতে উৎসাহ দেওয়া হয়। ব্যবসা চালানোর জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সুদমুক্ত এক লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। ব্যবসা শেষে শিক্ষার্থীরা এ টাকা ফেরত দেবেন। বাজার পরিচালনায় শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাসহ সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
গাইবান্ধা শহরের জিরো পয়েন্টে জেলার চারটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক এসে মিলিত হয়েছে। সড়কগুলো হলো গাইবান্ধা-সুন্দরগঞ্জ সড়ক, গাইবান্ধা-সাঘাটা সড়ক, গাইবান্ধা-বালাসি (ফুলছড়ি) সড়ক ও গাইবান্ধা-পলাশবাড়ী সড়ক। সেখান থেকে শহরের পাইকারি পুরাতন বাজারের দূরত্ব মাত্র ৫০০ গজ। জনতার বাজার প্রতিদিন সকাল ১০টায় শুরু হয়ে চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত।
আজ বুধবার জনতার বাজার ও অন্য বাজার ঘুরে দেখা গেছে, জনতার বাজারে প্রতি কেজি ফুলকপি ৫২ টাকা ও অন্য বাজারে ৬০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে জনতার বাজারে আলু ৫৭ টাকা ও অন্য বাজারে ৭০ টাকা; বেগুন ৩০ টাকা ও অন্য বাজারে ৬০ টাকা; লাউ (বড়) প্রতিটি ২০ টাকা ও অন্য বাজারে ৬০ টাকা; করলা প্রতি কেজি ৪৫ টাকা ও অন্য বাজারে ৮০ টাকা; ঢ্যাঁড়স ৭৫ টাকা ও অন্য বাজারে ৮০ টাকা; কাঁচা মরিচ ৭৫ টাকা ও অন্য বাজারে ১২০ টাকা; পেঁপে ৬০ টাকা ও অন্য বাজারে ৭০ টাকা; মিষ্টিকুমড়া ৫৫ টাকা ও অন্য বাজারে ৬০ টাকা; শিম ৮০ টাকা ও অন্য বাজারে ৮৫ টাকা এবং বাঁধাকপি জনতার বাজারে ৪৫ টাকা ও অন্য বাজারে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, জেনেশুনে মানুষ জনতার বাজারে কেনাকাটা করতে এসেছেন। কেউ কেউ অন্যের কেনাকাটা দেখে নিজেও কিনছেন। অনেকে তরকারির গুণমান যাচাই করছেন। চার শিক্ষার্থী অতনু সাহা, নাহিদ হাসান, নেওয়াজ আহমেদ ও রাফিদ মোত্তাকিন বেচাকেনা করছেন। তাঁদের কেউ তরকারি মেপে দিচ্ছেন, আবার কেউ টাকা নিচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা পালা করে বেচাকেনার কাজ করছেন।
সকালে জনতার বাজারে কেনাকাটা করছিলেন গৃহিণী শারমিন আক্তার (৩৪)। বাড়ি সদর উপজেলার খোলাহাটি গ্রামে। শারমিন বললেন, ‘শহরে এসেছিলাম মেয়ের জামাকাপড় কিনতে। বাড়ি থেকে শহরের জিরো পয়েন্ট হয়ে মার্কেটে যেতে হয়। যেতেই দেখি এই বাজার। লোকজনের কেনাকাটা দেখে রিকশা থেকে নামি। মূল্যতালিকা দেখে মনে হলো, অন্যান্য হাটবাজারের চেয়ে এখানে দাম অনেক কম। তাই প্রায় ৫০০ টাকার তরিতরকারি কিনলাম।’
কেনাকাটার পর ফুলছড়ির বালাসি গ্রামের রিকশাচালক বাবলু মিয়া (৫০) বলেন, ‘এ্যামরা (ছাত্ররা) যদি কম দামোত জিনিসপাতি বেচপ্যার পায়, তাহলে বাজারের দোকানদাররা বেচে না ক্যা। ওমরা (ব্যবসায়ীরা) বুদ্দি (সিন্ডিকেট) করি জিনিসপাতির দাম বেশি ন্যায়। পোত্তেক দিন বাজারোত পোরসাসনের নোক যাওয়ান দরক্যার।’
বাজারের উদ্যোক্তাদের এক শিক্ষার্থী অতনু সাহা বলেন, সাদুল্যাপুর ও সুন্দরগঞ্জের কৃষকদের কাছ থেকে পাইকারি দরে তরকারি কিনে তাঁরা বিক্রি করছেন। এ জন্য কম দামে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রথম দিকে কম বিক্রি হলেও ধীরে ধীরে বিক্রি বেড়েছে। বাজারে সবজির দাম সহনীয় পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত জনতার বাজার চালু থাকবে।
জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা জানান, নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে জেলার বিশেষ টাস্কফোর্স কমিটি শহরের পুরাতন বাজারে দফায় দফায় অভিযান চালায়। এরপরও ওই বাজারে দাম কমছে না। এ বাস্তবতায় ওই বাজারের পাশে গড়ে ওঠা জনতার বাজার বিশেষ ভূমিকা রাখবে।
শিক্ষার্থীদের এ উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন শহরের সংস্কৃতিকর্মী জিয়াউর রহমান। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা প্রাণ দিয়ে স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছে। তারা ট্রাফিক ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। এখন স্বেচ্ছাশ্রমে জনতার বাজার চালাচ্ছে। তাদের এই মহতী মনোভাব অব্যাহত থাকলে দেশ অনেক দূর এগিয়ে যাবে।