পাঁচ বছর ধরে জাহাজের বিভিন্ন পদে চাকরি করেছিলেন সজিবুল ইসলাম। সম্প্রতি জাহাজের চাকরিতে পদোন্নতি পেতে পরীক্ষা দিয়েছিলেন তিনি। সেই ফলাফলের অপেক্ষায় ছিলেন। মাঝের এই সময়টায় অলস বসে না থেকে সপ্তাহ দুয়েক আগে এমভি আল-বাখেরা জাহাজে গ্রিজার পদে চাকরি নেন তিনি। চাঁদপুরের হাইমচরে দুই দিন আগে এমভি আল-বাখেরা জাহাজে যে সাতজন হত্যাকাণ্ডের শিকার হন, তাঁদের একজন সজিবুল।
সজীবুল ইসলামের বাড়ি মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার পলাশবাড়িয়া ইউনিয়নে। গতকাল মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে তাঁর মরদেহ গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়। মাস পাঁচেক আগে বিয়ে করেছিলেন সজিবুল।
সজিবুলের মামা আহাদ সর্দার গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগামীকাল (আজ) ওর বিয়ের পাঁচ মাস পূর্ণ হবে। পদোন্নতি হলে বেতন বাড়বে, বড় জাহাজে চাকরি হবে—এ কারণে পরীক্ষা দিয়েছিল। দুই সপ্তাহ আগে বাড়িতে ধান কাটার কাজ করে গেছে। যাওয়ার সময় বাড়িতে বলে গেছে রেজাল্টের অপেক্ষায় ঘরে বসে না থেকে ছোট একটা জাহাজে কাজ করে আসি, তাতে কিছু রোজগার হবে। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল।’
জাহাজে নিহত ব্যক্তিদের আরেকজন হলেন একই ইউনিয়নের চর যশোবন্তপুর গ্রামের আনিচুর রহমানের ছেলে মো. মাজিদুল ইসলাম (১৬)। মাজিদুল ঝামা বরকাতুল উলুম ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। মাদ্রাসা বন্ধ থাকায় জাহাজে কাজ নিয়েছিল কিশোর মাজিদুল।
গতকাল বিকেলে চর যশোবন্তপুর গ্রামে নিহত মাজিদুল ইসলামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে স্বজনেরা মাতম করছেন। তখনো মাজিদুলের মরদেহ এসে পৌঁছেনি। পরে মরদেহ এসে পৌঁছালে রাতেই স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়।
মাজিদুলের স্বজনেরা বলেন, স্থানীয় একটি মাদ্রাসা থেকে নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা দিয়েছিল মাজিদুল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি থাকায় চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে জাহাজে কাজ নিয়েছিল ওই কিশোর। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে ছোট মাজিদুলের আরেক ভাই ও এক চাচা আগে থেকেই জাহাজে চাকরি করেন। তাঁদের মাধ্যমে এমভি আল-বাখেরা নামের জাহাজে চাকরিতে যান ওই কিশোর।
নিহত কিশোরের চাচি মোছা আফরোজা প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাদ্রাসা ছুটি থাকায় এ সময়ে কিছু টাকা রোজগারের আশায় প্রথমবারের মতো জাহাজের চাকরিতে গিছিল মাজিদুল। ফিরল লাশ হয়ে। ঘটনার আগে রাতেও মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা কইছে সে। এ শোক সহ্য করা যায় না। আমরা এর বিচার চাই।’
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে মহম্মদপুর ও নড়াইল সীমান্তবর্তী কয়েকটি ইউনিয়নের বহু মানুষ জাহাজে চাকরি করেন। এর আগে ২০২২ সালের অক্টোবরে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে এমভি সুলতান সানজানা নামের লাইটার জাহাজডুবির ঘটনায় মহম্মদপুর পলাশবাড়িয়া ইউনিয়নের চারজন নিহত হন।
সোমবার এমভি আল-বাখেরা নামের ওই জাহাজ থেকে মোট সাতজনের রক্তাক্ত দেহ উদ্ধার করে নৌ পুলিশ। এর মধ্যে পাঁচজনকে পাওয়া যায় মৃত অবস্থায়। দুজনকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এর বাইরে গুরুতর আহত একজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
চাঁদপুরের হাইমচরের ঈশানবালা খালের মুখ এলাকায় মেঘনা নদীর একটি ডুবোচরে এমভি আল-বাখেরা নামের জাহাজটি নোঙর করা ছিল। সোমবার বেলা তিনটার দিকে নৌ পুলিশ লাশগুলো উদ্ধার করে।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, রক্তাক্ত দেহগুলো জাহাজের কর্মীদের ঘুমানোর কক্ষে কক্ষে পড়ে ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। কারও কারও মাথায় গভীর ক্ষত দেখা গেছে। কারও কারও ছিল গলা কাটা। শরীরের অন্যান্য স্থানেও আঘাত ছিল।