চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাজারগুলো ভরে গেছে নানা জাতের আমে। এসব বাজার এখন দিনভর সরগরম থাকছে আম কেনাবেচায়। তবে প্রায় সব জাতের আম দবদাহের কারণে নির্দিষ্ট সময়ের আগে পেকে গেছে। এ কারণে আমের এ রাজধানীতে যথার্থ দাম পাচ্ছেন না চাষিরা।
জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট দেশের সবচেয়ে বড় আমের বাজার। রোববার সকাল সাতটার দিকে কানসাটে গিয়ে দেখা যায়, ব্যাটারিচালিত রিকশাভ্যানে বড় ডালিভর্তি করে আম আনা হচ্ছে বাজারে। মূলবাজারে স্থান সংকুলান না হওয়ায় শিবগঞ্জ-সোনামসজিদ আঞ্চলিক মহাসড়ক, শিবগঞ্জ-ভোলাহাট সড়কের পাশে ও শিবগঞ্জের শ্যামপুর চামাবাজারসহ কয়েক কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে বসেছে আমের বাজার।
স্থানীয় ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, গোপালভোগ আম ওঠার মধ্য দিয়ে ২৫ মে শুরু হয়েছে বাজার। বাজারে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিখ্যাত ক্ষীরসাপাতি ও ল্যাংড়া উঠেছে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে। এরপর থেকে বাজার জমজমাট হয়ে ওঠে।
বাজারে কথা হয় কানসাটের পুকুরিয়া গ্রামের আমচাষি আবু নূহ, মো.রায়হান, আব্বাস বাজারের মো.শরিফ, রহনপুর স্টেশনপাড়ার মো. ভু্ট্টুর সঙ্গে।
তাঁরা প্রথম আলোকে বলেন, এবার প্রচণ্ড গরমের কারণে ক্ষীরসাপাতি ও ল্যাংড়া আম আগেভাগেই পাকতে শুরু করে। বাজার শুরুর তিন-চারদিনের মাথায় আসতে শুরু করে ক্ষীরসাপাতি ও ল্যাংড়া আম। শুরুতে দাম ঠিকমতো পেলেও একসঙ্গে প্রচুর আম বাজারে আসতে শুরু করলে দরপতন শুরু হয়। এরপর আবার এখন দাম কিছুটা বাড়লেও তা কাঙ্ক্ষিত নয়। গরমের কারণে এর মধ্যেই তিনভাগের দুভাগ আম পাকার পর পেড়ে ফেলা হয়েছে। বাকি আম বিক্রি করে লোকসান পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।
এসব আমচাষি জানিয়েছেন, ল্যাংড়া আম মণপ্রতি ১ হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার টাকা, ক্ষীরসাপাতি ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার, লক্ষণভোগ ৩৫০ থেকে ৬০০ টাকা, বোগলাগুটি ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে এ বাজারে আম বিক্রি হয় ৫২ থেকে ৫৪ কেজিতে মণ ধরে। বেশ কয়েক বছর ধরে এ নিয়ম চলে আসছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তাঁরা।
শিবগঞ্জ ম্যাংগো প্রডিউসার কো-অপারেটিভ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক আমচাষি ইসমাইল খান প্রথম আলোকে বলেন, সার, কীটনাশক, ছত্রাকনাশকের দাম এবং সেচ ও শ্রমিকের খরচ বাড়ায় আম উৎপাদনের খরচ বেড়েছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। বেড়েছে পরিবহন খরচও। দাবদাহের প্রভাব তো আছেই। কিন্তু সে অনুযায়ী দাম না পাওয়ায় লোকসান গুনতে হচ্ছে তাঁদের।
কানসাটের পুলিশমাইল এলাকার আমচাষি আবদুল মতিনের নিজ বাগানের গাছ থেকে বেছে বেছে পাকা লক্ষণভোগ আম পাড়ছিলেন। এ সময় তিনি হতাশা প্রকাশ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্ষিরসা-ল্যাংড়ার তো দাম কম। লখনা (লক্ষণভোগ) বিক্রি হচ্ছে পানির দরে। চার-পাঁচশ টাকা মণ দরে। এ জন্য আমি কাঁচা আম পাড়ছি না। দাম উঠলে বেচব।’
দাবদাহের কারণে বাগানে প্রচুর পরিমাণ ক্ষীরসাপাতি আম পেকে ঝরে পড়ছে বলে জানিয়েছেন আমচাষি ও ম্যাংগো ফাউন্ডেশনের সভাপতি আহসান হাবিব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাঙ্ক্ষিত মূল্য না থাকায় কানসাটের বাজারে আম নামাচ্ছি না। আম রপ্তানিকারক এক ক্রেতার সঙ্গে কথা চলছে। ভালো দাম পেলে বেচব। খরা আমাদের ক্ষতির মুখে ফেলেছে।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জের আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের (আম গবেষণা কেন্দ্র) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ইউসুফ আলী প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত ক্ষীরসাপাতি আম বাজারে আসে জুন মাসের ৭ তারিখের দিক। কিন্তু এবার এ আম মাসের প্রথম দিন থেকেই বাজারে এসেছে। এরপরে নামে ল্যাংড়া আম। কিন্তু এবার ল্যাংড়াও একসঙ্গে এসেছে। এখন তো শুনছি ফজলি ও আম্রপালিও পাকতে শুরু করেছে। এগুলো সাধারণত জুন মাসের শেষ সপ্তাহে বাজারে আসে। প্রচণ্ড গরমে আম আগাম পেকে যাওয়ায় ক্ষতি হচ্ছে চাষি ও ব্যবসায়ীদের।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জেলায় ৩৭ হাজার ৫৮৮ হেক্টর জায়গাজুড়ে আমচাষ হয়েছে। এবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মুনজের আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘কৃষি বিভাগ হেক্টরপ্রতি আমের যে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে, এর থেকে বেশি উৎপাদন হয়েছে। তবে দাম নিয়ে হতাশ আমচাষিরা। আমাদের ধারণা, মোট আমের বাজারমূল্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার কম নয়।’
প্রচণ্ড গরমের কারণে একসঙ্গে বেশি আম পেকে যাওয়ায় চাষিরা দাম কম পেয়েছে বলে জানিয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষি বিপণন কর্মকর্তা নূরল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন ক্ষিরসা আম গড়ে তিন হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি হলেও গাছে আর বেশি আম নেই। ল্যাংড়া আমেরও কাঙ্ক্ষিত মূল্য পাচ্ছেন না চাষিরা। মোটের ওপর দাম নিয়ে সন্তুষ্ট নন তাঁরা।