গোলপাতা সংগ্রহের মৌসুমকে সামনে রেখে সুন্দরবনসংলগ্ন লোকালয়ের নদীর তীরে নৌকা মেরামতে ব্যস্ত সময় পার করছেন বাওয়ালিরা। ২৮ জানুয়ারি থেকে বাওয়ালিদের গোলপাতা সংগ্রহে সুন্দরবনে প্রবেশের অনুমতি দেবে বন বিভাগ। এর আগে নৌকা মেরামতের এই সময়কে বাওয়ালিরা বলেন শারণের সময়।
সুন্দরবন থেকে যাঁরা গোলপাতা সংগ্রহ করেন, তাঁদের বলা হয় বাওয়ালি। বাওয়ালিদের গোলপাতা সংগ্রহের বিশেষ ধরনের নৌকাগুলো আকৃতিতে অনেক বড় হওয়ায় অনেকে বড় নৌকা বলেন। আবার কেউ কেউ বলেন ‘পেটকাটা’ নৌকা। অনুমতিপ্রাপ্ত ৫০০ মণ ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একেকটি নৌকা ২৮ দিন করে সুন্দরবনে থেকে গোলপাতা আহরণ করতে পারবে। আগামী ৩০ মার্চ পর্যন্ত চলবে গোলপাতা আহরণের মৌসুম।
খুলনার কয়ার উপজেলার কয়রা নদীর চরে দাঁড়িয়ে বাওয়ালি আবদুল মালেক গাইন বলেন, ‘আমার বড় নৌকাটি ১২ বছর আগে তৈরি করা। এখন প্রতিবছর গোলপাতা আহরণের আগে মেরামত করা লাগে। এতে খরচ হয় প্রায় ৭০ হাজার টাকা। আর নতুন একটি নৌকা নির্মাণে খরচ প্রায় সাড়ে ৬ লাখ টাকা।’ তিনি আরও বলেন, গোলপাতা আহরণের নৌকাগুলো অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যায় না। এ কারণে গোলপাতার মৌসুম শেষ হলে নৌকাগুলো নদীর চরে ফেলে রাখতে হয়।
গত বছর ২০০টি নৌকা নিয়ে হাজারখানেক বাওয়ালি সুন্দরবনে ঢুকেছিলেন। এতে ৩৭ হাজার ৬০ কুইন্টাল গোলপাতা কর্তনে ভ্যাটসহ রাজস্ব আদায় হয় ২৫ লাখ ৭৪ হাজার ৮০০ টাকা। এ বছরও তেমনটাই হবে বলে জানিয়েছেন বন বিভাগের খুলনা রেঞ্জ গোলপাতা আহরণ কূপ (জোন) কর্মকর্তা মো. তানজিলুর রহমান। তিনি বলেন, ২৮ জানুয়ারি থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত দুই মাসব্যাপী বাওয়ালিরা সুন্দরবনে নির্ধারিত স্পট থেকে গোলপাতা আহরণ করবেন। একটি নৌকায় সর্বোচ্চ ২০০ কুইন্টাল (৫০০ মণ) গোলপাতা বহন করা যাবে। অতিরিক্ত বহন করলে দ্বিগুণ টাকা জরিমানা করা হবে। গোলপাতা ছাড়া বাওয়ালিরা সুন্দরবন থেকে অন্য কোনো কাঠ সংগ্রহ করতে পারবেন না।
গত বৃহস্পতিবার সকালে কয়রা উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন কপোতাক্ষ, শাকবাড়িয়া ও কয়রা নদীর পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, নদীর চরে বাওয়ালিরা পুরোনো নৌকা মেরামতে ব্যস্ত। বড় নৌকাগুলো কাত করে শক্ত কাঠ দিয়ে বেঁধে নিচের পাটাতনে তক্তা বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার কোনো কোনো নৌকায় দেওয়া হচ্ছে আলকাতরার প্রলেপ।
কয়রা নদীর চরে নৌকার পাটাতনে তক্তা বসিয়ে দিচ্ছিলেন কাঠমিস্ত্রি মো. নুর আলী গাজী। কাজের ফাঁকে তিনি জানান, সারা বছরই নৌকা তৈরি ও মেরামতের কাজ করেন তিনি। গোলপাতা আহরণের সময় এলে বড় নৌকাগুলো শারণের কাজ হয় বেশি। বছরের অন্য সময় সুন্দরবনে জেলেদের নৌকা তৈরি ও মেরামতে ব্যস্ত থাকতে হয়।
শাকবাড়িয়া নদীর পাড়ে কথা হয় বাওয়ালি কামরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, এ বছর নৌকা মেরামতে খরচ বেশি হচ্ছে। ১৪ কেজির একপাত্র আলকাতরার দাম ৩ হাজার ৩০০ টাকা। একটি নৌকায় আলকাতরা লাগে ১০ পাত্র। সে হিসাবে শুধু আলকাতরা কেনায় খরচ হয় ৩৩ হাজার টাকা। এরপর আবার মিস্ত্রি, শ্রমিক, কাঠ ও লোহা কেনা খরচ তো আছে।
কামরুল ইসলাম বলেন, বন বিভাগ থেকে গোলপাতা আহরণের জন্য বড় একটি নৌকার অনুমতি পেতে ১১ হাজার টাকার মতো রাজস্ব দিতে হয়। শ্রমিকের খরচও অনেক বেড়েছে। ২০ হাজার টাকা মাসিক মজুরিতে একজন শ্রমিক নিতে হয়। সব মিলিয়ে সুন্দরবন থেকে এক নৌকা গোলপাতা আনতে লাখ টাকার ওপরে খরচ হয়। এখন আর আগের মতো গোলপাতার ব্যবসা নেই। তারপরও জীবিকার তাগিদে পুরোনো পেশা টিকিয়ে রেখেছেন।