উখিয়ার আশ্রয়শিবিরে পাল্টা হামলার শঙ্কায় নির্ঘুম রাত রোহিঙ্গাদের

কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান
ছবি: সংগৃহীত

কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-৮ পশ্চিম) মিয়ানমারের দুটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে গোলাগুলি ও সংঘর্ষে পাঁচজন নিহতের ঘটনায় থমথমে অবস্থা চলছে। আশ্রয়শিবিরের কয়েকটি এলাকায় গভীর রাতে ফাঁকা গুলির শব্দ শুনেছেন রোহিঙ্গারা। কয়েকজন রোহিঙ্গাকে পেটানোর খবরও পাওয়া গেছে। হত্যার প্রতিশোধ নিতে পাল্টা হামলার শঙ্কায় গতকাল শুক্রবার রাত নির্ঘুম কেটেছে রোহিঙ্গাদের।

রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, আশ্রয়শিবিরের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে কয়েকটি জায়গায় আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) এবং মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সন্ত্রাসীরা মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। অপহরণ আতঙ্কে আশ্রয়শিবিরের অন্তত ৩০ জন মাঝি (রোহিঙ্গা নেতা) ক্যাম্প-৮ ছেড়ে আশপাশের ক্যাম্পে আত্মগোপন করেছেন। থমথমে পরিস্থিতি থাকায় সাধারণ রোহিঙ্গারা ঘরের বাইরে যেতে সাহস পাচ্ছেন না।

গতকাল রাতে আশ্রয়শিবিরের একটি ঘরের ভেতরে কয়েকজন রোহিঙ্গা নারী–পুরুষকে আটকে রেখে মারধর করা হয়েছে এবং লাঠি দিয়ে পিটিয়ে তাঁদের মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে এক রোহিঙ্গা নেতার দাবি। তিনি বলেন, নির্যাতনের ভিডিও চিত্র ধারণ করে গতকাল রাতে আরএসও সমর্থকেরা সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছেন। যেন ভিডিও চিত্র দেখে আরসার সমর্থক অন্যান্য রোহিঙ্গারা ক্যাম্প ত্যাগ করেন।

সাধারণ রোহিঙ্গাদের ভাষ্য, গতকাল সন্ধ্যার পর আরসা এবং আরএসওর সন্ত্রাসীরা আশ্রয়শিবিরে ঢুকে অস্ত্রের মহড়া দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের ঘরে ঢুকে নারী-পুরুষদের অত্যাচার-নির্যাতন করে লুটপাট চালানো হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে নির্ঘুম রাত কেটেছে তাঁদের।

এদিকে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া দুটি ভিডিও চিত্র প্রথম আলোর এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, আল ইয়াকিন (আরসা) সন্দেহে এক রোহিঙ্গা যুবককে একটি ঘরের মেঝেতে হাত–পা বেঁধে হাতুড়ি দিয়ে বেদম পেটানো হচ্ছে। যন্ত্রণায় রোহিঙ্গা যুবকটি ছটফট করে বারবার বলছিলেন, তিনি আল ইয়াকিন (আরসা) নন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক রোহিঙ্গা নেতা বলেন, হামলাকারীরা আরএসও সন্ত্রাসী। আশ্রয়শিবিরের বিভিন্ন ঘরে হানা দিয়ে তারা আরসার সমর্থক ও কর্মীদের শনাক্ত করে ক্যাম্প থেকে বিতাড়িত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। অন্যান্য ক্যাম্পেও একই কায়দায় আরসার সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে আরএসও সমর্থক রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন চালাচ্ছে। বিশেষ করে মিয়ানমারের দুটি সশস্ত্র গোষ্ঠী এক পক্ষ আরেক পক্ষের সমর্থকদের ওপর হামলা ও নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেওয়ায় সাধারণ রোহিঙ্গারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। সন্ত্রাসীদের ধরতে ক্যাম্পজুড়ে বিশেষ যৌথ অভিযান পরিচালনা করা দরকার।

রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, এপিবিএন যখন আশ্রয়শিবিরে অভিযান শুরু করে, তখন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা আশ্রয়শিবিরের বিভিন্ন আস্তানা কিংবা পাশের পাহাড়-জঙ্গলে অবস্থান নেয়। অভিযান শেষ হলে রাতের বেলায় কাঁটাতারের বেড়া কেটে সন্ত্রাসীরা আশ্রয়শিবিরে ঢুকে অপকর্ম শুরু করে। তখন সাধারণ রোহিঙ্গার পাশে কাউকে পাওয়া যায় না। আশ্রয়শিবিরগুলোর অবস্থান দুর্গম পাহাড়ের ঢালুতে। এর ফলে ঘটনাস্থলে দ্রুত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পৌঁছানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। সরু কাঁচা রাস্তাগুলো দিয়ে মোটরসাইকেল চালানোও সম্ভব নয়।

আশ্রয়শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সহকারী পুলিশ সুপার (অপারেশন ও মিডিয়া) মো. ফারুক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সন্ত্রাসীদের ধরতে আশ্রয়শিবিরে অভিযান চালানো হচ্ছে। সাধারণ রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তায় সেখানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা রয়েছে। পরিস্থিতি এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।

এপিবিএন জানায়, গতকাল ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে বালুখালী আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-৮ পশ্চিম) আরসা ও আরএসও এর মধ্যে গোলাগুলি ও সংঘর্ষে পাঁচ আরসা সদস্য নিহত হন। নিহত ব্যক্তিরা হলেন বালুখালী আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-৮ ডব্লিউ) এইচ-৪৯ ব্লকের বাসিন্দা আনোয়ার ছাদেক (২২), একই আশ্রয়শিবিরের এ-২১ ব্লকের বাসিন্দা মোহাম্মদ হামিম (২১), বালুখালী আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-১০) এইচ-৪২ ব্লকের বাসিন্দা মো. নজিবুল্লাহ (৩২), মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-৩) বি-১৭ ব্লকের বাসিন্দা নুরুল আমিন (২২) ও অজ্ঞাতনামা ২৫ বছর বয়সী আরেকজন রোহিঙ্গা।
ময়নাতদন্তের পর লাশগুলো গতকাল রাতে আশ্রয়শিবিরে দাফন করা হয়েছে জানিয়ে উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল বালুখালী আশ্রয়শিবিরে ছয় রোহিঙ্গা নিহতের ঘটনায় আজ শনিবার সকাল ১০টা পর্যন্ত থানায় মামলা হয়নি। তবে মামলার প্রস্তুতি চলছে।

এ ঘটনার ৯ ঘণ্টা পর গতকাল বেলা ৩টার দিকে বালুখালী আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-১১) ছুরিকাঘাতে ছানা উল্লাহ (৪৩) নামের আরেক রোহিঙ্গা যুবককে হত্যা করা হয়েছে। তিনি আরএসও সমর্থক বলে জানা গেছে।

রোহিঙ্গাদের নির্যাতন ও নির্যাতনের ভিডিও চিত্র ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে এপিবিএন কর্মকর্তা ফারুক আহমেদ বলেন, আরসার সঙ্গে আরএসওর বিরোধ দীর্ঘদিনের। আশ্রয়শিবিরের নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তার এবং পূর্বশত্রুতার জের ধরে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গারা মিলে আরেকটি অপহরণ চক্রও সক্রিয় রয়েছে। সবাইকে ধরতে অভিযানের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে।

পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে একাধিক সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় অন্তত ৫৭ জন নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১৭ জন রোহিঙ্গা মাঝি, ১৬ জন আরসা সদস্য, একজন আরএসও সদস্য, ১ জন স্বেচ্ছাসেবক এবং অন্যরা সাধারণ রোহিঙ্গা।