কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় নৃশংস জঙ্গি হামলার সাত বছর পূর্ণ হলো আজ শুক্রবার। হামলার সাত বছর হয়ে গেলেও এ ঘটনায় হওয়া মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ এখনো শুরু হয়নি। ফলে আটকে আছে বিচার কার্যক্রম। সে দিনের সেই ঘটনার দুঃসহ স্মৃতি এখনো ভুলতে পারেননি স্থানীয় বাসিন্দারা। ঘটনার সর্বোচ্চ বিচার দাবি করেন তাঁরা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ৭ জুলাই ছিল ঈদুল ফিতরের দিন। নামাজ শুরুর আগমুহূর্তে ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের অদূরে আজিম উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ের কাছে পুলিশের তল্লাশির সময় জঙ্গিরা গ্রেনেড হামলা করে। এ ছাড়া তাদের চাপাতির কোপে দুই পুলিশ কনস্টেবল আনছারুল হক ও জহিরুল ইসলাম মারা যান। আহত হন আরও ১২ পুলিশ সদস্য। পরে জঙ্গিরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ঘটনাস্থলে জঙ্গি আবির রহমান মারা যান। উভয় পক্ষের গোলাগুলির মধ্যে নিজ বাসায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান এলাকার গৃহবধূ ঝর্ণা রাণী ভৌমিক। ওই সময় আটক করা হয় জঙ্গি শফিউল ও স্থানীয় তরুণ জাহিদুল ইসলাম ওরফে তানিমকে। পরে একই বছরের ৪ আগস্ট ময়মনসিংহ জেলার নান্দাইল উপজেলার ডাংরি এলাকায় র্যাবের সঙ্গে এক বন্দুকযুদ্ধে শফিউল নিহত হন। ঘটনার তিন দিন পর ১০ জুলাই তৎকালীন পাকুন্দিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ সামসুদ্দীন বাদী হয়ে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে কিশোরগঞ্জ মডেল থানায় একটি মামলা করেন।
পুলিশ ২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে আর ২৮ নভেম্বর এ মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়। মামলাটি বর্তমানে কিশোরগঞ্জের প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। তবে কয়েক দফা এ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করে পেছানো হয়েছে। এ মামলার তদন্ত শেষে মোট ২৪ জনকে আসামি করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে ১৯ জন মারা যান। বর্তমানে অভিযুক্ত আসামি হলেন কিশোরগঞ্জ শহরের জাহিদুল হক ওরফে তানিম (২৭), গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের রাঘবপুরের জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজিব গান্ধী (৩৪), কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার সাদীপুর (কাবলিপাড়া) গ্রামের সোহেল মাহফুজ (৩৫), চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার হাজারদীঘা গ্রামের বড় মিজান (৬২) ও জঙ্গির আশ্রয়দাতা গাইবান্ধা এলাকার আনোয়ার হোসেন (৪৮)। তাঁরা সবাই বর্তমানে দেশের বিভিন্ন কারাগারে বন্দী আছেন।
কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ বলেন, শোলাকিয়া হামলার ঘটনাটি এখন আদালতে বিচারাধীন। পুলিশের পক্ষ থেকে ২০১৮ সালের ১২ সেপ্টেম্বর অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। এ মামলায় দোষীদের যাতে সর্বোচ্চ শাস্তি হয়, সে কামনা করেন তাঁরা।
কিশোরগঞ্জ জেলা আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি (পিপি) আবু নাসের মো. ফারুক বলেন, শোলাকিয়া হামলার ঘটনায় পুলিশ তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে। মামলাটি বিচারের জন্য প্রস্তুত হয়। এই মামলায় যাঁরা অভিযুক্ত, তাঁরা হলি আর্টিজানসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আরও সন্ত্রাসমূলক ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকায় তাঁদের বিভিন্ন আদালতে উপস্থিত করতে হয়। যে কারণে একসঙ্গে তাঁদের কিশোরগঞ্জ আদালতে হাজির করানো সম্ভব হয়নি। ফলে মামলাটি বিচারের জন্য প্রস্তুত হওয়া সত্ত্বেও বিচারকাজ বিলম্বিত হয়। গত ৬ জুন এ মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ছিল। এ দিন ১৭ জন সাক্ষীকেও হাজির করা হয়েছিল। তবে পাঁচ আসামির মধ্যে একজন আসামিকে হাজির করতে না পারায় সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ আবারও পিছিয়ে ২৫ জুলাই ধার্য করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আমরা আশা করি, এই মামলায় ইতিমধ্যে যে সাক্ষ্য প্রমাণ সংগৃহীত হয়েছে আদালতে উপস্থাপনের মাধ্যমে সন্দেহাতীতভাবে সম্পূর্ণরূপে এটা প্রমাণিত হবে এবং এ মামলায় অভিযুক্ত আসামি যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করবে রাষ্ট্রপক্ষ।’
ঝর্ণা রাণীর স্বামী গৌরাঙ্গ নাথ ভৌমিক এ হত্যাকাণ্ডের দ্রুত বিচার দাবি করে বলেন, এ ঘটনায় তাঁর পুরো পরিবারটা তছনছ হয়ে গেছে। সাত বছর হয়ে গেলেও এ ভয়াবহ হামলার ঘটনার ক্ষত এখনো শুকায়নি। মনে হলে এখনো শিওরে উঠে। আজও কানে বাজে মুহুর্মুহু সেই গুলির আওয়াজ। তিনি বলেন, ‘আমার পরিবার এখনো সেই দুঃসহ ভয়াবহ স্মৃতি ভুলতে পারছে না। এই দুঃখ, এই কষ্ট এখনো আমাদের দুই ছেলে শুভদেব ও বাসুদেবকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। আমরা এখনো স্বজন হারানোর বেদন কাটিয়ে উঠতে পারিনি।’
ঝর্ণা রাণীর ছোট ছেলে শুভদেব বলে, মাকে এখনো মনে পড়ে তার। মায়ের স্মৃতি ভুলতে পারছে না সে। সে আক্ষেপ করে বলে, মা ছাড়া জীবন অনেক কষ্টের। কারও জীবন যেন তাঁর মতো না হয়।
এ দিকে শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে জঙ্গি হামলার সপ্তম বছরপূর্তিতে আত্মোৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যসহ নিহত ব্যক্তিদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়েছে কিশোরগঞ্জ জেলা পুলিশ। আজ শুক্রবার সকালে ঘটনাস্থল চরশোলাকিয়া সবুজবাগ মোড়ে নির্মিত অস্থায়ী বেদিতে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ ও পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ জেলা পুলিশের কর্মকর্তাদের নিয়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
এ সময় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে বক্তব্য দেন জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ আফজল, সিভিল সার্জন সাইফুল ইসলাম, সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মামুন আল মাসুদ খান, পৌর মেয়র মো. পারভেজ মিয়া, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) মো. মোস্তাক সরকার। সেখানে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সপুর (ডিএসবি) মোহাম্মদ নূরে আলম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো. আল আমিন হোসাইন, সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মনতোষ বিশ্বাস, সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ দাউদ ও নিহত ঝর্ণা রাণীর স্বামী গৌরাঙ্গ দেবনাথ।
শ্রদ্ধা নিবেদন ও আলোচনা শেষে আত্মোৎসর্গকারী শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া পরিচালনা করেন পুলিশ লাইনস জামে মসজিদের পেশ ইমাম মো. মুসলেম উদ্দিন। এ ছাড়া শোলাকিয়ায় ইদগাহ মাঠে নিরাপত্তা ডিউটিতে নিয়োজিত থাকা অবস্থায় শহীদ দুই পুলিশ সদস্যের পরিবার ও নিহত ঝর্ণা রাণীর পরিবারকে পুলিশ সুপারের পক্ষ থেকে বিশেষ উপহারসামগ্রী দেওয়া হয়। এ উপলক্ষে কিশোরগঞ্জের সব থানা-মসজিদ ও পুলিশ লাইনস মসজিদে বাদ জুমা শহীদদের আত্মার মাগফিরাতের জন্য বিশেষ দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়।