ছাত্র আন্দোলনে নিহত ইকরামুল হক সাজিদের মা লিপি বেগমকে সমবেদনা জানান তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। বৃহস্পতিবার সকালে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার বিলকুকরী গ্রামে
ছাত্র আন্দোলনে নিহত ইকরামুল হক সাজিদের মা লিপি বেগমকে সমবেদনা জানান তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। বৃহস্পতিবার সকালে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার বিলকুকরী গ্রামে

‘আমার সাজিদের নাম মিশা গেল গো...’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী ইকরামুল হক সাজিদ (২৫) টিউশনি করে চলতেন। বহুদিন থেকে তাঁর ইচ্ছা ছিল, নিজের টাকায় তাঁর সব আত্মীয়স্বজনকে একদিন টাঙ্গাইলের গ্রামের বাড়িতে দাওয়াত করে খাওয়াবেন। সে কথা বলেছিলেন বাবা জিয়াউল হককে। বলেছিলেন স্বজনদের তালিকা করতে। তালিকা করেও ফেলেছিলেন জিয়াউল হক। তারিখ ঠিক করে গ্রামে আসতে চেয়েছিলেন সাজিদ। আজ বৃহস্পতিবার স্বজনদের প্রায় সবাই এসেছিলেন সাজিদদের গ্রামের বাড়িতে। তবে দাওয়াত খেতে নয়, তাঁরা চোখের জলে চিরবিদায় জানালেন সাজিদকে।

৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন সাজিদ। মাথার পেছনে গুলি লেগে ডান চোখ দিয়ে বের হয়ে যায়। গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নেওয়ার পর ওই রাতেই তাঁর অস্ত্রোপচার হয়। তারপর ১০ দিনেও আর জ্ঞান ফেরেনি। গতকাল বুধবার দুপুরে তাঁর মৃত্যু হয়। ঢাকা সিএমএইচ ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জানাজা শেষে গতকাল দিবাগত রাত দুইটার দিকে গ্রামের বাড়িতে তাঁর মরদেহ আনা হয়।

আজ সকালে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার বিলকুকরী গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে সাজিদকে দাফন করা হয়। এর আগে স্থানীয় বাঐজান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে তাঁর তৃতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক মো. কায়ছারুল ইসলাম, পুলিশ সুপার মো. গোলাম সবুর, ধনবাড়ী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ওয়াদুদ তালুকদার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোস্তাফিজুর রহমান, ঢাকা থেকে আসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাসহ ধনবাড়ী উপজেলার বিভিন্ন স্তরের মানুষ জানাজায় অংশ নেন।

ছাত্র আন্দোলনে নিহত ইকরামুল হক সাজিদের জানাজায় উপস্থিত লোকজনের উদ্দেশে বক্তব্য দিচ্ছেন তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। বৃহস্পতিবার সকালে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার বিলকুকরী গ্রামে

পরে উপদেষ্টা নাহিদ সাজিদের বাড়িতে গিয়ে তাঁর মা–বাবা ও স্বজনদের সমবেদনা জানান। এ সময় তিনি উপস্থিত লোকজনের উদ্দেশে বলেন, ‘আজ সাজিদদের এই আত্মত্যাগের কারণে আমরা নতুন স্বাধীনতা পেয়েছি। তাঁর আত্মত্যাগ বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ কোনো দিন ভুলবে না। খুনিদের বিচার অবশ্যই করা হবে এই বাংলার মাটিতে। অবশ্যই তাঁদেরকে আমরা কঠোরতম শাস্তির আওতায় আনবই।’

আজ দুপুর ১২টার দিকে সাজিদদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির সামনে জাতীয় পতাকায় ঢাকা রয়েছে তাঁর কবর। বাড়ির একটি কক্ষে বিলাপ করছেন তাঁর মা লিপি বেগম। স্বজনেরা তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। কিন্তু কোনো সান্ত্বনাই তাঁকে শান্ত করতে পারছিল না। তিনি চিৎকার করে বলছিলেন, ‘আমার সাজিদের নাম মিশা গেল গো...। আমি দুনিয়াতে কেমনে বাচমু গো...।’

সাজিদের ভগ্নিপতি অর্ক ফুয়াদ জানান, সাজিদের জন্ম ১৯৯৯ সালের ১ মার্চ। তিনি ঢাকার বিএএফ শাহীন কলেজ থেকে ২০১৬ সালে এসএসসি, ২০১৮ সালে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে ভর্তি হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে।

ছাত্র আন্দোলনে নিহত ইকরামুল হক সাজিদের কবরে দোয়া পাঠ করেন তাঁর সহপাঠী ও স্বজনেরা। বৃহস্পতিবার সকালে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার বিলকুকরী গ্রামে

সাজিদের বাবা জিয়াউল হক বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার। অবসরের পর তিনি ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। এই সূত্রে পরিবার নিয়ে ঢাকার কাফরুল এলাকায় বসবাস করেন। জিয়াউল হক বলেন, ‘লেখাপড়ার পাশাপাশি সাজিদ টিউশনি করত। সে আমাকে বলত, আর কয়েকটি মাস। এরপর আমাকে আর চাকরি করতে দেবে না। পরিবারের সব দায়িত্ব সে নিয়ে নেবে। গ্রামের সব আত্মীয়স্বজনকে একদিন দাওয়াত করে খাওয়াতে চেয়েছিল। ওর কথামতো স্বজনদের তালিকাও করেছিলাম। কিন্তু আর খাওয়ানো হলো না।’

ইকরামুল হক সাজিদ

সাজিদের মামা আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘গ্রামে এসে আমাদের সবাইকে দাওয়াত করে এনে সাজিদ খাওয়াতে চেয়েছিল। সে গ্রামে এল, আমরাও ওদের বাড়িতে আসলাম। কিন্তু দাওয়াত খেতে নয়, ওকে চিরবিদায় জানাতে।’

সাজিদের বড় বোন ফারজানা হক (৩০) জানান, শুরু থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সাজিদ ছিলেন সক্রিয়। এ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর প্রতিটি কর্মসূচিতে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। ৪ আগস্ট ঢাকার অবস্থা ছিল উত্তাল। তাই বাসা থেকে বের হতে বাধা দিতে চেয়েছিলেন তাঁর মা। কিন্তু সাজিদ বাধা মানবেন না জানতেন তাঁরা। তাই বাধা না দিয়ে মা গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, সাবধানে থাকতে। বেলা আড়াইটার দিকে সাজিদ কাফরুলের বাসা থেকে বের হয়ে যান। যাওয়ার পর মা ও বোনের সঙ্গে কয়েকবার কথা হয়। সন্ধ্যা সাতটার দিকে তাঁর বন্ধুরা জানান, সাজিদ গুলিবিদ্ধ হয়ে সিএমএইচে আছেন। পরিবারের লোকজন সেখানে গিয়ে দেখতে পান, তিনি অজ্ঞান অবস্থায় আছেন। মাথার পেছন দিয়ে গুলি লেগে ডান চোখ ভেদ করে বের হয়ে গেছে। ওই রাতেই তাঁর অস্ত্রোপচার হয়। তারপর ১০ দিনেও জ্ঞান ফেরেনি। গতকাল দুপুরে মারা গেলে আজ সকালে গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়েছে।