বগুড়ায় পৈতৃক সম্পত্তি জবরদখলের প্রতিকার চেয়ে আট বছর ধরে আদালত, প্রশাসন, পৌরসভা ও সরকারি দপ্তরে ধরনা দিয়ে বিচার না পেয়ে উল্টো ভূমি কার্যালয় ও বগুড়া পৌরসভার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হয়রানির শিকার হয়েছে প্রতিবন্ধী এক পরিবার। এখন প্রধান উপদেষ্টা ও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে ওই সম্পত্তি রক্ষা নিয়ে প্রশাসন ও পৌরসভায় গিয়ে পদে পদে হয়রানি ও দুর্ভোগের কথা তুলে ধরতে চান ওই প্রতিবন্ধী পরিবারের সন্তান বগুড়া পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্য বৃন্দাবনপাড়ার তরুণ বিপ্লব হোসেন মণ্ডল।
প্রধান উপদেষ্টা ও রাষ্ট্রপতির সাক্ষাৎ চেয়ে গতকাল বুধবার ও গত মঙ্গলবার আলাদা আলাদাভাবে ই-মেইল পাঠিয়েছেন বিপ্লব। তিনি ভ্যান ও ইজিবাইক চালানোর পাশাপাশি বগুড়ার টিএমএসএস টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছেন।
বিপ্লব গতকাল সন্ধ্যায় মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বাবা শ্রবণপ্রতিবন্ধী ছিলেন। আমার বড় ভাইও শ্রবণপ্রতিবন্ধী। ১০ শতাংশের পৈতৃক একখণ্ড সম্পত্তি আমাদের পরিবারের সম্বল। অথচ ২০১৬ সালে তিন শতক জায়গা স্থানীয় এক প্রভাবশালী দখল করে নেন। উচ্ছেদ চেয়ে আদালতে মামলা করা হয়। বিরোধপূর্ণ সম্পত্তিতে অন্য পক্ষ যাতে না আসতে পারে, এ জন্য আদালতের অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা আছে। অথচ আদালতে বিচারাধীন থাকা সম্পত্তি বগুড়া সদর ভূমি কার্যালয় অনৈতিক সুবিধা নিয়ে নামজারি করে দিয়েছে। এ ছাড়া বগুড়া পৌরসভা প্রভাবিত হয়ে হোল্ডিং খুলে বিরোধপূর্ণ জমিতে ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদন দিয়েছে। নামজারি, হোল্ডিং ও নকশা বাতিল চেয়ে প্রশাসন ও পৌরসভায় ধরনা দিয়েও প্রতিকার মেলেনি। বাধ্য হয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও রাষ্ট্রপতি স্যারের সঙ্গে সাক্ষাৎ পেতে ঢাকায় এসেছি।’
প্রধান উপদেষ্টার কাছে পাঠানো অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, বিপ্লবের বাবা সামাদ মণ্ডল শ্রবণপ্রতিবন্ধী ও পেশায় মোটরসাইকেলের মিস্ত্রি ছিলেন। ২০২০ সালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। অসুস্থ বৃদ্ধা মা ছাড়া ছোট ভাইয়ের পড়ালেখার খরচ চলে ইজিবাইক চালানোর উপার্জনে। সামাদ ১৯৮০ সালে ফুলবাড়ি মৌজার বৃন্দাবনপাড়া পতিত শ্রেণির ১১০৬১ ও ১১০৬৪ দাগে কবলা দলিলমূলে ১৪ শতকের দুই খণ্ড সম্পত্তি ক্রয় করেন। পৈতৃকসূত্রে মালিকানা আরও আধা শতাংশের। মোট সাড়ে ১৪ শতক সম্পত্তির মধ্যে ৪ শতক সম্পত্তি অন্যের কাছে বিক্রি করেন। এর মধ্যে ১১০৬৪ দাগে বাড়ি নির্মাণ করে সপরিবার বসবাস করছিলেন। ২০১১ সালে সামাদের নামে ১০ শতক জায়গা বগুড়া সদর উপজেলা ভূমি কার্যালয় থেকে কাগজপত্র বিচার সাপেক্ষে নামজারি করে দেয়। সামাদের ভোগদখলে থাকা ওই সম্পত্তির মধ্যে ২০১৬ সালে হোটেল ব্যবসায়ী নূর আলম ও তাঁর স্ত্রী কল্পনা খাতুন তাঁদের নামে ১১০৬৪ দাগে তিন শতক জায়গা কবলা করেন। কিন্তু সন্ত্রাসীদের সহযোগিতায় ১১০৬১ দাগের জায়গা জবরদখল করে রাতারাতি স্থাপনা গড়ে তোলেন। দখল উচ্ছেদ চেয়ে জেলা ও পুলিশ প্রশাসনে ধরনা দিয়েও কাজ না হওয়ায় আদালতে মামলা করা হয়। আদালত অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা দেন।
প্রধান উপদেষ্টার কাছে করা অভিযোগপত্রে বিপ্লব আরও উল্লেখ করেন, ২০২২ সালের ১৬ এপ্রিল আদালতের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে সন্ত্রাসীদের সহযোগিতায় কল্পনা ও তাঁর স্বামী নূর আলম দখল করা জায়গায় স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ১১ মে প্রভাব খাটিয়ে পৌরসভা থেকে কল্পনা হোল্ডিং খোলার চেষ্টা করেন। অভিযোগ পেয়ে ওই বছরের ২৮ জুলাই পৌরসভার বিরোধ মীমাংসা সালিস বোর্ডে পৌরসভার তৎকালীন মেয়র রেজাউল করিম হোল্ডিং বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিলেও এক মাসের মাথায় আদালতে অমীমাংসিত জায়গায় ২৮ আগস্ট পৌরসভা থেকে স্থাপনা নির্মাণে নকশা অনুমোদন দেওয়া হয়। অনুমোদন দেওয়া নকশা বাতিল চেয়ে আবেদন করা হলেও পৌরসভা তা বাতিল করেনি। পরে এ বিষয়ে আদালতে আরেকটি মামলা করা হলে আবারও অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। পরে নামজারি বাতিলে মিস কেসের আবেদন করা হলে সদর উপজেলার তৎকালীন সহকারী কমিশনার (ভূমি) নাছিম রেজা সরেজমিন তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিল করার নির্দেশ দেন নিশিন্দারা ইউনিয়ন উপসহকারী ভূমি কর্মকর্তাকে। দীর্ঘদিন তদন্ত আটকে থাকায় প্রতিকার চেয়ে পুনরায় সহকারী কমিশনারের (ভূমি) সঙ্গে যোগাযোগ করেন বিপ্লব। এবার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সদর উপজেলা ভূমি কার্যালয়ের কানুনগো হেদায়েতুল ইসলামকে।
বিপ্লব দাবি করেন, তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে হেদায়েতুল পাঁচ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করেন। ঘুষ দেওয়ার সামর্থ্য না থাকায় এ বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি নামজারি বাতিলে মিস কেসের আবেদন খারিজ করে দেওয়া হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) কাছে আপিল আবেদন করেন। ২ মে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে প্রতিকার চাইলে তদন্ত করে খারিজ বাতিলে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তিনি সদরের ইউএনওকে নির্দেশ দেন। কিন্তু ইউএনও নামজারি বাতিলে কোনো ব্যবস্থা নেননি। বিষয়টি নিয়ে দিনের পর দিন সদরের ইউএনওর কার্যালয়ে ধরনা দিলেও প্রতিকার মেলেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফিরোজা পারভীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালতে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত খারিজ বাতিলের সুযোগ নেই। তবুও ডিসি স্যারের নির্দেশে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সদরের সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) বলা হয়েছিল। ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত আগস্টে ভূমি কার্যালয় পুড়িয়ে দেওয়া হয়। নথিপত্র পুড়ে যাওয়ায় বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে বিলম্বিত হচ্ছে। এ ছাড়া আবেদনকারীর কাছে বারবার সম্পত্তির মালিকানার বিষয়ে নথিপত্র চাওয়া হলেও তিনি তা সরবরাহ করেননি।’
বগুড়া পৌরসভার প্রশাসক ও স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মাসুম আলী বেগ বলেন, প্রধান উপদেষ্টার কাছে করা অভিযোগের একটি কপি পৌরসভায়ও পাঠানো হয়েছে। নিয়মবহির্ভূতভাবে হোল্ডিং খোলা ও নকশা অনুমোদন করা হয়ে থাকলে তদন্ত সাপেক্ষে তা বাতিল করা হবে।