পাইকারি বাজারে নিজের খেতের সবজি বিক্রি করতে এসেছেন এক কৃষক। রোববার সকালে ঠাকুরগাঁও শহরের গোবিন্দনগর পাইকারি সবজি বাজারে
পাইকারি বাজারে নিজের খেতের সবজি বিক্রি করতে এসেছেন এক কৃষক। রোববার সকালে ঠাকুরগাঁও শহরের গোবিন্দনগর পাইকারি সবজি বাজারে

কৃষকের দেড় টাকার সবজি যেভাবে ১৫ টাকায় কিনছেন ভোক্তা

এবার তিন বিঘা জমিতে শসার আবাদ করেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার নারগুন গ্রামের কৃষক জাহাঙ্গীর আলম। আজ রোববার সকালে খেতের শসা নিয়ে শহরের পাইকারি সবজি বাজারে আসেন। অপেক্ষার পরও ক্রেতা পাচ্ছিলেন না। পরে এক আড়তদারের কাছে ৮০ কেজির প্রতি বস্তা শসা বিক্রি করেন ১০০ টাকায়। আড়তদার সেই শসা স্থানীয় ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করেন বস্তাপ্রতি ২০০ টাকা। শহরের কালীবাড়ি বাজারের কাঁচামাল ব্যবসায়ী মো. পারভেজ সেই শসা কিনে এনে বিক্রি করছেন প্রতি কেজি ১৫ টাকায়।

শুধু শসাই না, এখন কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যায়ে সব ধরনের সবজির দামের তফাত এমন। শসা, টমেটো, বেগুন, লাউসহ কয়েকটি সবজির দাম পড়ে গেছে। সেসব সবজি বাধ্য হয়ে ফড়িয়াদের কাছে বিক্রি করছেন কৃষকেরা। ফড়িয়ারা তা ব্যবসায়ীর হাতে তুলে দিচ্ছেন। ব্যবসায়ীর হাত ঘুরে ভোক্তাকে সেই সবজি কিনতে হচ্ছে কয়েক গুণ বেশি দামে। এতে একদিকে কৃষকেরা লোকসান গুনছেন, অন্যদিকে সাধারণ ভোক্তারাও ঠকছেন।

ঠাকুরগাঁওয়ে ব্যাপক সবজির আবাদ হয়। সাধারণত পাইকারেরা খেত থেকে সবজি সংগ্রহ করে দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করেন। কোনো কোনো কৃষক সরাসরি পাইকারি বাজারে সবজি এনে বিক্রি করেন। আজ শহরের গোবিন্দনগরের পাইকারি সবজি বাজারে দেখা গেছে, কৃষকেরা নানা জাতের সবজি নিয়ে এসেছেন। দরাদরি করে ফড়িয়াদের কাছে সেই সবজি বিক্রি করছেন।

সদর উপজেলার পূর্ব বেগুনবাড়ি গ্রামের কৃষক নুর হোসেন একটি ইজিবাইকে করে কয়েক বস্তা শসা এনেছেন। কিন্তু বিক্রি হচ্ছিল না। শেষে ফড়িয়ার কাছে প্রতি কেজি শসা দেড় টাকা দরে বিক্রি করেন। নুর হোসেন বললেন, ‘বাজারে শসার যে দাম, মজুরির খরচই উঠছে না। এবার শসার আবাদ করে ধরা খাইলাম।’ কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, সেই ফড়িয়া প্রতি বস্তা শসা ব্যবসায়ীর কাছে ২০০ টাকায় বিক্রি করে দেন।

বালিয়াডাঙ্গীর সাহবাজপুর গ্রামের কৃষক আবুল হোসেন টমেটো বিক্রি করতে এসেছেন। আবুল হোসেন বলেন, ‘খেতে বেশি দিন রাখায় টমেটো নষ্ট হওয়ার হওয়ার পথে। বাধ্য হয়ে বাজারে নিয়ে এসেছি। কিন্তু দাম নাই। প্রতি কেজি টমেটো ৫ টাকায় বিক্রি করলাম। আগে কখনো এত খারাপ দাম যায়নি।’

কহরপাড়া গ্রামের চাষি মনসুর আলী ৪০ শতক জমিতে লাউ লাগিয়ে ছিলেন। লাউ বিক্রি করতে এসে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত রোদের মধ্যে ক্রেতার জন্য অপেক্ষা করেন। উপায়ন্তর না দেখে শেষে ফড়িয়ার কাছে ১০০ টাকায় ৩৫টি করে লাউ বিক্রি করেন। মনসুর আলী বললেন, ‘খেতের লাউ বিক্রি করে পাঁচ হাজার টাকাও ওঠাতে পারিনি।’

রানীশংকৈল উপজেলার রাউতনগর গ্রামের শসাচাষি সনাতন রায় বলেন, ‘দুই সপ্তাহ আগে খেতেই প্রতি মণ শসা ৮০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। এখন ক্রেতা নেই। শসা ‍বিক্রি করতে এনে ভটভটি ভাড়া বাদ দিয়ে ৩৮০ টাকা টিকেছে।’

আজ পাইকারি বাজারে প্রতিটি চালকুমড়া ১৬ টাকা, প্রতি কেজি লম্বা বেগুন ১২ থেকে ১৫, চিচিঙ্গা ১৭, করলা ২০, পটোল ১২, ঢ্যাঁড়স ১৩, বরবটি ২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। শহরের কালীবাড়ি বাজারে প্রতি কেজি দেশি শসা ২৫, হাইব্রিড শসা ১৫, টমেটো ২০, লাউ প্রতিটি ১৫ থেকে ২০, প্রতি কেজি লম্বা বেগুন ২৫, চিচিঙ্গা ২৫, করলা ৪০, ঢ্যাঁড়স ২০, পটোল ২০, বরবটি ৪০ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।  

কালীবাড়ি বাজারে সবজি কিনতে এসে শহরের আশ্রমপাড়া মহল্লার বাসিন্দা বেলাল হোসেন বলেন, ‘কৃষক প্রতি কেজি শসা দেড় টাকায় বিক্রি করলেও আমরা ভোক্তারা কিনছি ১৫ থেকে ২৫ টাকায়। কৃষক ও ভোক্তার মধ্যে দামের এত তফাত মেনে নেওয়া যায় না।’

এ বিষয়ে ‘বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার’ পাওয়া চামেশ্বরী গ্রামের মেহেদী আহসান উল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা অনেক সবজির আবাদ করি। আমাদের বিক্রির জন্য পাইকারদের ওপর নির্ভর করতে হয়। পাইকারেরা ওই সবজি বেশি দামে ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করেন। ব্যবসায়ীরা আবার দাম বাড়িয়ে দেন। ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কষ্ট করে ফসল ফলাই আমরা। আর লাভ করেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা।’

কালীবাড়ি বাজারের কাঁচামাল ব্যবসায়ী মো. পারভেজ বলেন, তাঁরা যত সবজি দোকানে আনেন, সব এক দিনে বিক্রি হয় না। অনেক সময় পচে নষ্ট হয়। অনেক ক্রেতা সবজি বাছাই করে নেন। তাই কেনা দামের থেকে দু-চার টাকা বাড়িয়ে বিক্রি না করলে লোকসান গুনতে হয়।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের ঠাকুরগাঁওয়ের সহকারী পরিচালক শেখ সাদী প্রথম আলোকে বলেন, কাঁচাবাজারে তাঁরা কোনো কেনাবেচা রাখেন না। এ জন্য কে বেশি মূল্য নিচ্ছে, সেটা নিশ্চিত করাটা মুশকিল। ঠাকুরগাঁওয়ের কৃষি বিপণন কর্মকর্তা সাখওয়াত হোসেন বলেন, কৃষক যাতে তাঁদের উৎপাদিত পণ্যের সঠিক দাম পান, সে জন্য নিয়মিত বাজার পরিদর্শন করছেন তাঁরা।