সুনামগঞ্জের চলতি নদ সীমান্ত থেকে এসে সুরমা নদীর যে স্থানে মিশেছে, সেটির নাম সদরগড়। সুরমা থেকে চলতি নদের একেবারে প্রবেশমুখে কয়েকটি বাঁশ পোঁতা। একটি বাঁশে লাল পতাকা টাঙানো। তীরের চায়ের দোকান থেকে এক যুবক এসব বাঁশ দেখিয়ে জানান, প্রশাসন বালু লুট বন্ধে বাঁশের বেড়া দিয়েছিল, যাতে নদের ভেতর বাল্কহেড ও নৌকা না ঢুকতে পারে; কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। বালুখেকোরা বেড়া দেওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যেই ভেঙে ফেলে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে সেখানে সরেজমিনে দেখা যায়, বালু উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। এ সময় দোকানে থাকা দুজন জানান, গতকাল বুধবার থেকে কোনো নৌকা নামেনি। অথচ তিন দিন আগে এখানে পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। পুলিশের চোখের সামনে দিয়ে শত শত বাল্কহেড ও নৌকায় বালু নেওয়া হয়েছে। ওই ব্যক্তিরা আলোচনা করছিলেন, ৫ আগস্টের পর আড়াই মাসে চলতি নদ থেকে শতকোটি টাকার বালু লুট হয়েছে। একপর্যায়ে সাংবাদিক পরিচয় জেনে কিছুটা চুপ হয়ে যান তাঁরা। একজন বলেন, ‘সোমবার নাকি সুনামগঞ্জে বড় অফিসার আইব। এর লাগি মনে অয় সবাই একটু লুকাইছে।’
ওই দোকানঘর থেকে কিছুটা উত্তরে একটি ছাপরা ঘর দেখিয়ে একজন বললেন, ‘ওখানে পুলিশ আছে। তারার লগে গিয়ে মাতইন।’ তাঁর কথামতো ওই ছাপরা ঘরে গিয়ে একজনকে পাওয়া গেল। তিনি পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে (ডিবি) আছেন। নিজে কথা না বলে জানালেন, কাছেই একই বিভাগের উপপরিদর্শক (এসআই) আব্বাস উদ্দিন আছেন। আব্বাস উদ্দিন পরিচয় জেনে বলেন, ভাই, দুই দিন ধরে নদী ‘শান্ত’। তিন দিন আগের চিত্র জানতে চাইলে নিজেদের অসহায়ত্ব তুলে ধরেন তিনি। জানান, এখানে তিনজন পুলিশ দায়িত্ব পালন করছেন। সদর থানা থেকে কিছু পুলিশও আসত। তবে বালুখেকো সিন্ডিকেট খুবই শক্তিশালী। নদীর উজান থেকে একসঙ্গে শত শত নৌকা যখন একসঙ্গে বালু নিয়ে নামত, তখন আটকানো তাঁদের (পুলিশ) পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ত। একটি নৌকা ধরতে গেলে ২০টি চলে যেত।
সদরগড় গ্রামের এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দিনে ২০০ থেকে ৩০০, আর রাতে অগুনতি নৌকা বালু লুটের কাজে নামত। ৩০০ ঘনফুট থেকে ১০ হাজার ঘনফুট বালু ধারণক্ষমতাসম্পন্ন স্টিলের এসব বড় নৌকা একটানা আড়াই মাস বালু তুলেছে। নদীর তীরে দিনে-রাতে শত শত লোকের ‘মেলা’ বসত। দুই দিন ধরে সবাই নিজেকে একটু আড়াল করেছেন।
পূর্ব সদরগড়, পশ্চিম সদরগড়, উড়ারকান্দা, মনিপুরিহাটি, কাইয়ারগাঁও গ্রামের ১৬ বাসিন্দার সঙ্গে বালু লুটের বিষয়ে কথা হয়। এর মধ্যে বালু ব্যবসায়ী, শ্রমিক, পরিবেশ আন্দোলনকর্মীসহ নানা শ্রেণি–পেশার লোক আছেন। তাঁরা জানান, প্রশাসন থেকে বিভিন্ন সময়ে কিছু কিছু উদ্যোগ নিলেও পুলিশ অনেকটা নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় ছিল। পুলিশের দুর্বলতা আর যোগসাজশে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বালুখেকোরা। এর সুযোগ নিচ্ছেন রাজনৈতিক দলের কর্মী, সাংবাদিকসহ অনেকে। এলাকাবাসী এই বালু লুটের পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী করেছেন সদর থানা ও জেলা গোয়েন্দা পুলিশের লোকজনকে। এর সঙ্গে নদীতীরের কিছু লোকের একটি সিন্ডিকেটের কথাও বলেছেন তাঁরা। যাঁরা পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করে থাকেন।
সদরগড় গ্রামের বাসিন্দা ফারুজ মিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘নদীর ইজারা বন্ধ, তাহলে সদর উপজেলা প্রশাসন টোল-ট্যাক্স, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ নানা নামে ঘাট ইজারা দেয় কীভাবে? আসলে এই বালু লুটে তলে–তলে কমবেশি সবার যোগসাজশ আছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি নদে মূলত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে বালু লুটের এই মচ্ছব শুরু হয়েছে। প্রতিদিন শত শত বাল্কহেড ও নৌকা নদে ঢুকে অবাধে বালু উত্তোলন ও পরিবহন করছে। ছোট নৌকা ৩০০ ঘনফুট আর বড় বড় বাল্কহেডে ১ হাজার থেকে ১০ হাজার ঘনফুট বালু পরিবহন করা হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা, শ্রমিক ও পরিবেশ আন্দোলনকর্মীদের দাবি, এই নদ থেকে প্রতিদিন ছোট-বড় ৩০০ নৌকায় কমপক্ষে ৫ লাখ ঘনফুট বালু তোলা হচ্ছে। প্রতি ঘনফুট বালুর দাম ৩০ টাকা (বর্তমান বাজারদর) করে হলে মাসে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা এবং গত আড়াই মাসে এখান থেকে ১১২ কোটি টাকার বালু লুট হয়েছে। অথচ এই নদের বালুমহাল ২০১৮ সাল থেকে ইজারা বন্ধ রয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশকে বারবার বলার পরও কোনো ফল না পেয়ে সুনামগঞ্জ পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের (সুপা) একটি প্রতিনিধিদল গত মঙ্গলবার (২২ অক্টোবর) সিলেটে গিয়ে বিভাগীয় কমিশনার ও পুলিশের উপমহাপরিদর্শকের (ডিআইজি) কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে। বিভাগীয় কমিশনার আগামী সোমবার সুনামগঞ্জে এসে বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনসহ বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার লোকজনের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন বলে জানা গেছে।
প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা ডলুরা সীমান্ত হয়ে ভারত থেকে চলতি নদ এসে শহরতলির সদরগড় এলাকায় সুরমা নদীতে মিশেছে। নদের ডলুরা এলাকায় ৩৭১ একর জমি নিয়ে একটি বালুমহাল রয়েছে। এই মহালের নাম ধোপাজান। একসময় এই নদে খননযন্ত্র (ড্রেজার, বোমা মেশিন) দিয়ে অবাধে বালু উত্তোলনের ফলে দুই তীরের বহু গ্রাম ও স্থাপনা ভাঙনের কবলে পড়ে। ব্যাপক ক্ষতি হয় প্রকৃতি ও পরিবেশের। এ কারণে ২০১৮ সালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক সিদ্ধান্তে চলতি নদের ধোপাজান বালুমহালের ইজারা বন্ধ করা হয়। এরপর থেকে এটি আর ইজারা হয়নি। তবে নদের তীরবর্তী এলাকার হাজারো শ্রমিক ছোট ছোট নৌকা দিয়ে বালু তুলে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
এই নদের বালু-পাথর ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নজির আহমদ বলেন, ‘যেহেতু নদী থেকে বালু উত্তোলন নিষিদ্ধ, তাই আমরা চুরি করে ব্যবসা করতে চাই না। ব্যবসায়ীরা না থাকলেও এখন শত শত মানুষ ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করছেন। প্রশাসন-পুলিশ সবাই দেখছে; কিন্তু এসব বন্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই।’
বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ সুনামগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, চলতি নদ এখন মাফিয়া চক্রের কবলে। আগে এলাকার সাধারণ বারকি শ্রমিকেরা ছোট ছোট নৌকা দিয়ে বালু তুলে সংসার চালাতেন, এখন ড্রেজারের কারণে হাজার হাজার বারকি শ্রমিক বেকার। লুটেরাদের কারণে তাঁদের জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে।
সুনামগঞ্জ পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের (সুপা) সভাপতি এ কে এম আবু নাছার জানান, নদীতে বালু লুট শুরুর পর নানাভাবে তাঁরা বিষয়টির প্রতিবাদ জানিয়েছেন। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার কাছে লিখিত দিয়েছেন; কিন্তু কোনো ফল হয়নি। আবু নাছার বলেন, ‘আমি জেলা কোর কমিটির সভায় সবার সামনে বলেছি, পুলিশ এখান থেকে সুবিধা নিয়ে বালু লুটের সুযোগ করে দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতি আগে কখনো আমরা দেখিনি।’
সুনামগঞ্জের পুলিশ সুপার আ ফ ম আনোয়ার হোসেন খান অবশ্য পুলিশের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, চলতি নদীতে বালু-পাথর উত্তোলন সম্পূর্ণ অবৈধ। যাঁরা এসব অবৈধ কাজে যুক্ত, তাঁদের বিরুদ্ধে পুলিশ ব্যবস্থা নিচ্ছে। পুলিশের বিরুদ্ধে একটি পক্ষ অপপ্রচার চালাচ্ছে। তবে যদি পুলিশের কেউ জড়িত থাকেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এই নদীতে অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। ইতিমধ্যে বেশ কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিয়মিত অভিযান হচ্ছে। এটি অব্যাহত থাকবে।’