অসুস্থতা, বার্ধক্য ও শীত উপেক্ষা করে রিকশা নিয়ে বেরিয়েছেন সামছুল হক। মঙ্গলবার দুপুরে চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলা পরিষদ এলাকায়
অসুস্থতা, বার্ধক্য ও শীত উপেক্ষা করে রিকশা নিয়ে বেরিয়েছেন সামছুল হক।  মঙ্গলবার দুপুরে চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলা পরিষদ এলাকায়

‘শীতে রিকশা চালাইতে কষ্ট অয়, তবু অসুস্থ শরীর নিয়াই চালাই’

সামছুল হকের বয়স ৭০। নানা রোগ শরীরে। এর ওপর কয়েক দিন ধরে শীতের দাপট। তবু প্রতিদিন রিকশার চাকা (প্যাডেল) ঘুরিয়ে যা পাচ্ছেন, তা দিয়েই চালাচ্ছেন সংসারের খরচ। ৫৩ বছর ধরে তিনি রিকশা চালিয়ে সংসারের হাল ধরে আছেন।

সামছুল হকের বাড়ি চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার শোভনকর্দী গ্রামে। ওই গ্রামের ওয়াজউদ্দিন ঢালীর ছেলে তিনি। স্ত্রী, তিন মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে সামছুল হকের সংসার। ১৯৭১ সালের দিকে উপজেলা সদর ও আশপাশের এলাকায় রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ শুরু করেছিলেন তিনি।

মঙ্গলবার দুপুরে মতলব দক্ষিণ উপজেলা পরিষদের সামনে শীতে জবুথবু হয়ে যাত্রীর অপেক্ষা করছিলেন সামছুল হক। সেখানেই কথা হয় তাঁর সঙ্গে। জীবনের নানা প্রতিকূলতা, ঝামেলা-ঝক্কি, অসুস্থতা, অভাব ও নানা সমস্যার কথা উঠে আসে আলাপচারিতায়। কথার ফাঁকে ফুটে ওঠে তাঁর অদম্য মানসিকতার বিষয়টিও। তিনি বলেন, ‘অনেক দিন ধইরাই আমি অসুস্থ। মূত্রথলিতে পাথর হইছিল। ব্যাংক থেইক্কা ৫০ হাজার টেয়া ঋণ নিয়া বছর তিনেক আগে দুইবার অপারেশন করন লাগে। এহনো শরীর সুস্থ অয় নাই। হার্ট ও মাথাব্যথার অসুখও আছে। শরীল খুব দুর্বল। সপ্তাহে ২০০ টেয়ার ওষুধ লাগে। রিকশা চালাইয়া যা পাই তা দিয়া খরচ চলে না। খাইয়া না–খাইয়া থাওন লাগে। কয়েক দিন ধইরা খুব শীত। শীতে রিকশা চালাইতে কষ্ট অয়, তবু অসুস্থ শরীর নিয়াই চালাই।’

সামছুল হক জানান, ১৯৭১ সালে তাঁর বাবা মারা যান। তখন তাঁর বয়স ১৭ বছর। বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের ভার এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। মা–বাবা এবং ভাইবোনদের ভরণপোষণ জোগাতে ওই বয়সেই রিকশা চালানো শুরু করতে হয় তাঁকে। কর্জ করে তাঁর দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ওই ঋণের টাকা এখনো শোধ করতে পারেননি। ছোট মেয়ে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। একমাত্র ছেলে টুকটাক দিনমজুরির কাজ করেন। বেকার থাকে প্রায়ই। তাঁর (সামছুল) আয়েই চলে পরিবারের খরচ। প্রতিদিন রিকশা চালিয়ে গড়ে আয় করেন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। এ টাকা থেকে রিকশার মালিককে প্রতিদিন দেন ২০০ টাকা। মাসে গড়ে আয় করেন পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা। এ টাকায় সংসার চালানো কঠিন। বাজারে জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে এ টাকায় সংসার চালাতে হাঁপিয়ে উঠছেন।

সামছুল হক বলেন, ‘সকাল সাতটা থেইকা রাইত আটটা-নয়টা পর্যন্ত গাড়ি চালাই। গাড়ি না চালাইলে খামু কী। সংসারের খরচ কে দিব। তয় কারও কাছে হাত পাতনের চেয়ে, রাস্তায় ভিক্ষা করার চেয়ে খাইটা খাওয়াই ভালা। এলিগা কাম বন্ধ করি নাই।’

শোভনকর্দী গ্রামের কলেজশিক্ষক ও সামছুল হকের প্রতিবেশী মো. জাকির হোসেন বলেন, তিনি যাত্রীর কাছ থেকে এক টাকাও বেশি ভাড়া নেন না। ন্যায্য ভাড়া রাখেন। তিনি খুব বিনয়ী। রোদ-বৃষ্টি ও শীত উপেক্ষা করে এই বৃদ্ধ বয়সে তিনি যেভাবে রিকশা টেনে সংসার চালাচ্ছেন, তা তাঁর লড়াকু মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।