পাবনার বেড়া উপজেলার একটি সংগঠন শিক্ষার্থীদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার গড়ে তুলেছে।
ভ্যানের ওপরের অংশে সুদৃশ্য ছাউনি। ছাউনির নিচে কয়েকটি তাক। এসব তাকে সাজিয়ে রাখা নানা ধরনের বই। এসব বই নিয়ে ভ্যান ছুটে চলে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। টিফিনের সময় শিক্ষার্থীরা সেখান থেকে বই নিয়ে পড়ে। কেউবা আবার ওই ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারের খাতায় নাম, রোল নম্বর লিখে বই বাড়িতে নিয়ে যায়।
শিক্ষার্থীদের মুঠোফোনের গেমসের আসক্তি দূর করতে এবং বই পড়ায় আগ্রহী করার জন্য ব্যতিক্রমধর্মী এই উদ্যোগ নিয়েছেন পাবনার বেড়া উপজেলার একদল উদ্যমী তরুণ-তরুণী। মূল উদ্যোক্তাদের বেশির ভাগই বেড়া উপজেলার স্কুল-কলেজ থেকে পড়ালেখা শেষ করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছেন।
শিক্ষানুরাগী এসব শিক্ষার্থী একটি সংগঠন গঠন করেছেন। সেই সংগঠনের পক্ষ থেকে দুটি ভ্যানে ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার গড়ে তোলা হয়েছে। পালা করে ভ্যান দুটি বেড়া পৌর এলাকা ও উপজেলার হাটুরিয়া-নাকালিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে। ব্যতিক্রম এই ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার ইতিমধ্যেই সাড়া ফেলেছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, ২০১৬ সালে ঐতিহ্যবাহী সরকারি বেড়া বিপিন বিহারী উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির কয়েকজন শিক্ষার্থী গঠন করেন ‘শিক্ষার্থী সহযোগিতা সংগঠন’ নামের একটি জনকল্যাণমুখী সংগঠন। সে সময় তাঁরা টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে জনসেবামূলক নানা ধরনের কাজ শুরু করেন। শুরুর দিকে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের শিক্ষাসংক্রান্ত সহায়তাসহ দুস্থদেরও নানাভাবে সহায়তা করেছেন তাঁরা।
যেখানেই মানুষের অসহায়ত্বের খবর পেয়েছেন, সেখানেই তাঁরা পৌঁছে গিয়ে দুস্থদের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী, চিকিৎসাসামগ্রী, শীতবস্ত্র বিতরণ করেছেন। বর্তমানে এই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বেড়া উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী।
একসময় ‘শিক্ষার্থী সহযোগিতা সংগঠনের’ শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারলেন, স্কুল-কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবইয়ের বাইরে গল্প, উপন্যাস, কবিতা, ভ্রমণকাহিনি পড়ার ব্যাপারে তেমন আগ্রহী নয়। অধিকাংশ শিক্ষার্থীই মুঠোফোনে গেমস খেলে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মূল্যবান সময় নষ্ট করছে। অথচ পাঠ্যবইয়ের বাইরে সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্যের বই পড়লে জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত হয়। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের মুঠোফোনে গেমস খেলার বদভ্যাস ছাড়াতে এবং তাদের জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করতে পাঠাগার চালু করার উদ্যোগ নেন তাঁরা।
২০২৩ সালের জুলাই মাসে শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় যুক্ত করতে পাঠাগার চালু করার এ উদ্যোগের খবর জানতে পারেন বেড়ার তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহা. সবুর আলী। তাঁর উৎসাহ ও আর্থিক সহযোগিতায় শিক্ষার্থীরা তৈরি করেন ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার। এরপর শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে জোগাড় করেন সাত শতাধিক বই। এর পর থেকে বইসহ পাঠাগারটিকে বেড়া পৌরসভার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া শুরু হয়।
এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাঠাগারটিকে ঘিরে সাড়া পড়ে যায়। তিন চাকার ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারটি দেখামাত্রই শিক্ষার্থীরা এর সামনে এসে জড়ো হয়ে পছন্দমতো বই নিয়ে যায়। এটি পরিচালনার জন্য প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষার্থীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
ভ্রাম্যমাণ এই পাঠাগারকে ঘিরে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক সাড়া দেখে উদ্যোক্তা শিক্ষার্থীরা আরও একটি ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার তৈরির উদ্যোগ নেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ভ্যানের ওপরের অংশে একই নকশায় আরেকটি পাঠাগার তৈরির কাজ শুরু হয়ে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে শেষ হয়।
এরপর সেটির জন্য সংগ্রহ করা হয় আরও পাঁচ শতাধিক বই। দ্বিতীয় ভ্রাম্যমাণ পাঠাগারটি উপজেলার হাটুরিয়া-নাকালিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
পাঠাগারের উদ্যোক্তা শিক্ষার্থীরা জানান, একটি পাঠাগার পৌর এলাকায় এবং অপরটি হাটুরিয়া-নাকালিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।