দিনাজপুর শহরের বাসুনিয়াপট্টি দুর্গামন্দির প্রাঙ্গণে বছর পাঁচেক আগে একটি পাকুড় ও একটি বটগাছ লাগিয়েছিলেন দিলীপ ঘোষ। স্থানীয় লোকাচার অনুযায়ী বট-পাকুড়গাছ একত্রে বেড়ে উঠলে তাদের বিয়ে দেওয়ার রীতি প্রচলিত আছে। সেই লোকাচার মেনেই আজ বুধবার মহাধুমধামে অনুষ্ঠিত হলো ওই বট-পাকুড়গাছ দুটির বিয়ে।
বটগাছটিকে কনে ও পাকুড়গাছটিকে বর মেনে সনাতন ধর্মীয় রীতিতে যেভাবে মানুষের বিয়ের আয়োজন করা হয়, ঠিক সেভাবেই বিয়ের যাবতীয় আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে। বিয়েতে বরের বাবা-মায়ের ভূমিকায় ছিলেন দিলীপ ঘোষ (৩৫) ও দীপ্তি ঘোষ দম্পতি এবং কনের বাবা-মায়ের ভূমিকায় ছিলেন তাঁদের প্রতিবেশী মুন্না সাহা (৩৬) ও পূর্ণিমা সাহা দম্পতি। শহরের চকবাজারে দিলীপের মনিহারি দোকান রয়েছে। মুন্না চালের দোকান চালান। দুই পরিবার পঞ্জিকা দেখে তিথি-নক্ষত্র মেনে আজ ৩ মাঘ বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে। সঙ্গে অতিথিদের জন্য নিমন্ত্রণপত্র তৈরি, খাওয়াদাওয়ার আয়োজন, ছায়ামণ্ডপ তৈরি, বর-কনের সাজসজ্জা ও কেনাকাটা করা হয়।
বিয়ের অনুষ্ঠান দেখতে দূরদূরান্ত থেকে এসেছিলেন অনেকেই। আয়োজকদের একজন সদর উপজেলার জুবিলী উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক তরুণ ঘোষ বলেন, প্রকৃতি ও ব্যক্তির মঙ্গল কামনায় এ ধরনের বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। বিয়ের বেশির ভাগ ব্যয় বহন করেছেন বর-কনের বাবা-মায়েরা। পাশাপাশি ভক্তদের দান-দক্ষিণাও আছে।
বিয়ের আয়োজন শুরু হয় মূলত গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় গায়েহলুদের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। আজ দুপুরে বিয়ের মূল অনুষ্ঠানে দেখা যায়, মন্দির চত্বরের মাঝখানে থাকা বট ও পাকুড়গাছ দুটিকে লাল-হলুদ শাড়ি পরানো হয়েছে। গাছ দুটিকে পারানো হয় ফুলের মালা। বিয়ের মণ্ডপে আঁকা হয়েছে আলপনা। তাতে ধান-দুর্বা-হলুদ, সিঁদুর, ধূপকাঠি, কলা, দই, সন্দেশসহ বিভিন্ন পদের মিষ্টান্ন রাখা হয়েছে। বর-কনের বাবা-মাকে বসানো হয়েছে বেদির সামনে। পুরোহিত মন্ত্র পড়ছেন। চলছে উলুধ্বনি। অদূরে বাজছে বিয়ের সানাই, ঢাক, ঢোল, কাঁসর। বেদির চারপাশে নির্দিষ্ট দূরত্বে চেয়ারে বসেছেন নিমন্ত্রিত অতিথিরা।
বেলা আড়াইটার দিকে সনাতন ধর্মীয় রীতিতে মন্ত্রোচ্চারণের পরই সাত পাকে বাঁধা পড়ে বর-কনে। আমন্ত্রিত অতিথিরা বিভিন্ন উপঢৌকন দিয়ে বর-কনেকে আশীর্বাদ করেন। বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পরই অতিথিদের আপ্যায়নে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজনে ছিল খিচুড়ি ও সবজি। রাতে আয়োজন করা হয়েছে কবিগান ও পালাকীর্তনের।
বিয়েতে পুরোহিতের দায়িত্বে ছিলেন বিজয় কৃষ্ণ চক্রবর্তী। তিনি বলেন, একসঙ্গে বেড়ে ওঠায় বৃক্ষ দুটির বিয়ে দেওয়া হয়েছে। মূলত ব্যক্তির মোক্ষলাভ ও প্রকৃতি বিনাশের হাত থেকে রক্ষা করা এবং মানুষকে বৃক্ষপ্রেমী করে তোলার উদ্দেশ্যেই এই বিয়ের আয়োজন।
দিলীপ ঘোষ (বরের বাবা) বলেন, পাঁচ বছর আগে দিনাজপুর শহরের ফুলতলা শ্মশান এলাকায় বট-পাকুড় লাগানো অবস্থায় পান তিনি। পরে সেটিকে এনে শহরের চকবাজার চণ্ডীমন্দির চত্বরে একটি টবে লাগান। ২০২০ সালের আগস্ট মাসে বাসুনিয়াপট্টি দুর্গামন্দির চত্বরে স্থাপন করেন।
কনের মা পূর্ণিমা সাহা বলেন, ‘আমি মেয়ে বটেশ্বরীর মা। ছেলে পাকেশ্বরের বাবা-মা আমাদের প্রতিবেশী। উভয়ের মঙ্গল ও কল্যাণের জন্যই এই আয়োজন করেছি। আমরা দুই পরিবার বট-পাকুড়ের বিয়ে দিতে পেরে ভীষণ আনন্দিত।’
বিয়েতে নিমন্ত্রিত অতিথি স্বর্ণা রানী রায় (২৪) বলেন, ‘বট-পাকুড়ের বিয়ের কথা এত দিন শুনেছি। আজ নিজের চোখে দেখলাম। মানুষের বিয়ের মতোই আয়োজন করা হয়েছে। বিয়েবাড়ির আয়োজনে শরিক হতে পেরে খুবই ভালো লাগছে।’
বট-পাকুড়ের বিয়ের বিষয়ে লোকসংস্কৃতি-গবেষক ও দিনাজপুরের বীরগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মাসুদুল হক বলেন, এটি মূলত লোকাচার। ভারতবর্ষের রীতি অনুযায়ী সম্প্রীতি, মৈত্রী চুক্তি, সময় স্মারককে চিহ্নিত করতেই এই আয়োজন করা হতো। এ অঞ্চলের মানুষ বিশেষ মনোবাসনা পূর্ণ করতেও বট-পাকুড়ের বিয়ে দেন। তবে বৈষ্ণবীয় রীতি অনুযায়ী, রাধাকৃষ্ণ অভেদ আত্মা। দুটি সত্তাকে একত্র করতে মধ্যযুগে বৈষ্ণবীয় রীতিতেও বট-পাকুড়ের বিয়ের প্রচলন ছিল। তিনি বলেন, মেক্সিকোতে গাছের সঙ্গে মানুষের বিয়ে দেওয়ার রীতি আছে। সেখানে বৃহৎ বৃক্ষকে ধরা হয় শক্তির আকর। মূলত প্রকৃতিবাদীরা প্রকৃতিপ্রেম থেকে এই আয়োজন করেন।