নারায়ণগঞ্জ শহরের ১ নম্বর রেলগেট বটতলা এলাকায় ১৩০ বছর আগে ‘মিষ্টি মুখ’ নামে একটি মিষ্টির দোকান চালু করেন কেশব চন্দ্র ঘোষ। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার পাশাপাশি পরিবারের ঐতিহ্য ধরে রাখতে মিষ্টির ব্যবসায় যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। সেই থেকে এ দোকানের দই ও মিষ্টির সুনাম। পুরোনো এ দোকানের দই-মিষ্টির স্বাদ নিতে এখনো ক্রেতারা ভিড় করেন।
শুরুতে কেশব চন্দ্র ঘোষ লুচি, হালুয়া, রসগোল্লা, কাঁচা গোল্লা, ক্ষীর চপ, লালমোহন ও দই রাখতেন। দোকানটি এমন জায়গায়, এর আশপাশে নারায়ণগঞ্জ রেলস্টেশন, লঞ্চ টার্মিনাল ও কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল। প্রচুর মানুষের আনাগোনায় মিষ্টির বিক্রি ও সুনাম দ্রুতই ছড়িয়েছিল।
১৯৭৫ সালে কেশব মারা যান। তাঁর সাত ছেলের মধ্যে তিন ছেলে—গিরিধারী ঘোষ, ত্রিনাথ ঘোষ ও আদিনাথ ঘোষ মিষ্টির ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাকি চার ছেলে দেশভাগের সময় ভারতে চলে যান। সেখানেই তাঁরা মারা গেছেন। ১৯৮৮ সালে সড়ক সম্প্রসারণের কারণে বটতলায় মিষ্টি মুখের দোকান ভাঙা পড়ে। পরে পাশেই ‘নিউ মিষ্টি মুখ’ নামে দোকানটি স্থানান্তর করা হয়। তখন তাঁর দুই ছেলে গিরিধারী ও ত্রিনাথ দোকানটি চালাতেন। পরে ২০০০ সালে ত্রিনাথ ঘোষ নিউ মিষ্টি মুখের পাশে আলাদাভাবে ‘রসরাজ মিষ্টি মুখ’ নামে আরেকটি দোকান দেন।
এই পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের মিষ্টি ব্যবসায়ী ছিলেন গিরিধারী ঘোষের ছেলে সুবোধ চন্দ্র ঘোষ। সুবোধের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে সুদীপ্ত ঘোষ নিউ মিষ্টি মুখ পরিচালনা করছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের চার পুরুষের ব্যবসা মিষ্টি মুখ। মিষ্টি মুখের ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছি আমরা।’ তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন তাঁর দোকানে ১ হাজার ২০০ কেজি দুধ দিয়ে দই ও মিষ্টি তৈরি করা হয়। মিষ্টি মুখের ঐতিহ্য ৩০০ থেকে ৩৫০ গ্রাম ওজনের বড় চমচম। এটি চ্যালেঞ্জার নামেও পরিচিত। কেউ এটি অর্ডার দিলে তৈরি করে দেওয়া হয়।
মিষ্টি মুখে ৪২ বছর ধরে কাজ করছেন মোক্তার হোসেন। তিনি বলেন, আগে কাঁঠালপাতা ও মাটির হাঁড়িতে মিষ্টি বিক্রি করতেন তাঁরা। কাগজের প্যাকেট চালু হওয়ায় সেই ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে।
‘রসরাজ মিষ্টি মুখ’ দোকান চালু করা ত্রিনাথ ঘোষের বয়স এখন ৮৩ বছর। দোকানটি পরিচালনা করছেন তাঁর ছেলে কৌশিক ঘোষ। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন এই দোকানে ১৫ মণ দুধ দিয়ে দই ও মিষ্টি তৈরি করা হয়। আমাদের দুই দোকানই মিষ্টি মুখের অতীত ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছি। পুরোনো পদের সঙ্গে নতুন কিছু মিষ্টির পদ আনা হয়েছে।’
শহরের জিমখানা এলাকার ৭২ বছর বয়সী বাসিন্দা রবীন্দ্র নারায়ণ চক্রবর্তী। তিনি শহরের টানবাজারসহ কয়েকটি মন্দিরে পুরোহিতের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বলেন, পুরোনো তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি মিষ্টি মুখ। পুরোনো এই দোকানে মিষ্টির টানে আসা শহরের দেওভোগ দাতা সড়ক এলাকার বাসিন্দা প্রবাসী সেলিম আহমেদ বলেন, ‘মিষ্টি মুখের মিষ্টির আলাদা স্বাদ আছে। মিষ্টি খেতে মন চাইলে মিষ্টি মুখে ছুটে আসি।’
আলাদা স্বাদের জন্য মিষ্টি মুখের মিষ্টি খ্যাতি অর্জন করেছে বলে মনে করেন নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি ভবানী শংকর রায়। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে মিষ্টি মুখের মিষ্টি খাই। মিষ্টি মুখের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কেশব চন্দ্র ঘোষ স্কুলের ছাত্রদের ডেকে নিয়ে বিনা পয়সায় মিষ্টি খাওয়াতেন।’