বড় সড়ক থেকে গ্রামীণ পথে ঢুকতেই বোঝা গেল, এখন বাংলার প্রকৃতিতে অগ্রহায়ণ চলছে। সকালের ঘন কুয়াশা কিছুটা হালকা হতে শুরু করেছে। এ রকম সময়ে গ্রামের মাঠ যেন ‘আকাশের তলে/ ক্ষেতে–ক্ষেতে লাঙলের ধার/ মুছে গেছে,—ফসল কাটার/ সময় আসিয়া গেছে,—চ’লে গেছে কবে!—/ শস্য ফলিয়া গেছে,—তুমি কেন তবে/ রয়েছ দাঁড়ায়ে/ একা–একা!—ডাইনে আর বাঁয়ে/ খড়-নাড়া—পোড়ো জমি—মাঠের ফাটল,—/ শিশিরের জল!’
এ রকম পঙ্ক্তি যখন মনের ভেতর উড়ছে, তখন নাড়ার মাঠে হেমন্তের মৃদু রোদ ঝিলিক দিচ্ছে। এই হালকা, মিঠে রোদের ভেতরেই করিমপুরের একটি বাড়ি তখন নতুন এক কীর্তির সাফল্যে আলাদা হয়ে উঠেছে। করিমপুর মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মনুমুখ ইউনিয়নের একটি গ্রাম। এই গ্রামের ছেলে ইকবাল হাসান ইমন রোববার দুবাইয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপের ফাইনালে বাংলাদেশ দলের হয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ ও ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট হয়েছেন। এ খেলায় ভারতকে হারিয়ে টানা দ্বিতীয় বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ।
সোমবার সকাল ১০টার দিকে করিমপুরের এই বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, ইকবাল হাসানের আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীদের অনেকে এসেছেন। সময়টা হেমন্তের হলেও শীত পড়েছে। কিছু আগে অল্প দূরত্বেরও কিছু দেখা মুশকিল হয়েছে, এতটাই ঘন ছিল কুয়াশা। এমন সকালে খুব একটা দায়ে না পড়লে কেউ ঘর থেকে বের হতে চান না। পথেও লোকজনের উপস্থিতি কম দেখা গেছে। শুধু মাঠজুড়ে আমন ধান কাটার পর নাড়া আর পথের ওপর, পথের পাশে পড়ে আছে খড়ের স্তূপ। কিছু বাড়িতে চলছে ধানঝাড়াই। বাড়িতে বাড়িতে ধান গোলায় তোলার ব্যস্ততা চলছে।
ইকবাল হাসান ইমনের বাবা মো. আবু বকর প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলের সঙ্গে আজ (সোমবার) সকালে কথা হয়েছে। তবে বেশি কিছু বলতে পারেনি। বলেছে, দেশে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘ছেলের খেলার কথা কী বলব, খুশিতে আমার কানতে (কাঁদতে) ইচ্ছা করছে।’ প্রকৃতই তাঁর চোখে তখন টলমল করছিল আনন্দের জল।
পরিবার, প্রতিবেশী ও ক্রিকেট সংগঠকদের সূত্রে জানা গেছে, করিমপুরের কামারখালী নামে ছোট একটি নদীর পাশেই এই ক্রিকেটার ইকবাল হাসান ইমনের জন্ম। দুই বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। ওই গ্রামের মাঠে, খালের পাড়ে খেলাধুলা করেই তাঁর বেড়ে ওঠা। স্থানীয় শ্রীধরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক এবং রমিজ উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয় থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে ভর্তি হন মৌলভীবাজার জেলা সদরের কাশীনাথ আলাউদ্দিন হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজে। বাড়ি থেকে জেলা সদরের দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। অনেক কষ্ট করে তাঁকে আসা-যাওয়া করতে হয়েছে।
কাশীনাথ আলাউদ্দিন হাইস্কুল থেকে এসএসসি উত্তীর্ণ হয়েছেন। সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সময়ই খেলাধুলায় বেশি করে জড়িয়ে পড়েন। তৃতীয় শ্রেণি থেকেই ক্রিকেটের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক। গ্রামের মাঠে, বাড়ির উঠানে, স্কুলের আঙিনায় হাতের কাছে যা পেতেন, তা নিয়েই ক্রিকেটের মতো করে খেলতেন। কখনো বোলিং, কখনো ব্যাটিং। ক্রিকেটের প্রতি এই টান দেখে তাঁর মামা শাহ পারভেজ তাঁকে মৌলভীবাজার ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দেন। এ সময় তাঁকে সব রকম উৎসাহ, সহযোগিতা দিয়েছেন জেলার ক্রিকেট কোচ রাসেল আহমদ। তাঁর হাত ধরেই ক্রিকেটার ইকবাল হাসান ইমনের উত্থান। তবে তাঁর এই ক্রিকেটচর্চা, ক্রিকেট পরিভ্রমণের যাত্রাটি ততটা সহজ ছিল না।
ইকবালের বাবা আবু বকর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি তাকে স্বাধীন অবস্থায় চলতে সুযোগ দিছি। খেলতে কখনো বাধা দিছি না। তবে আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকায় তাকে বলেছি বিদেশ চলে যেতে। সে বলেছে তাকে দুইটা বছর সময় দিতে। তখন সে নিজেই যেতে পারবে। খুব কঠিন ছিল চলাফেরা। এক জোড়া জুতা কিনে দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না। তার কথায় ভাবলাম, কষ্ট তো কররামই (করতেছি)। না হয় আরও দুই বছর করলাম।’ তিনি বলেন, ‘কালকে (গত রোববার) যখন গ্রামের, এলাকার, অনেক দূরের মানুষ ফোন দিছে, তখন খুশি লাগের। তার মা–ও খুশি, ভাইবোন, চাচাসহ গ্রামের মানুষ, আত্মীয়স্বজন—সবাই খুশি। গ্রামের মানুষও তারে খুব উৎসাহ দিছেন। আমরার ঘরই নাই, কিন্তু চাইছি ছেলে সুনাম করতো, এতেই খুশি।’ তিনি (আবু বকর) জানান, তাঁদের (ইকবালের বাবা-চাচা) ছয় ভাইয়ের যৌথ একটি ভিটায় টিনের চালা ও টিনের বেড়ার একটি ঘর ছাড়া আর কিছু নেই। তিনি (ইকবালের পিতা) একটি ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। তা দিয়েই কষ্ট করে সংসার চালান।
মা শাহনাজ পারভিন প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ছেলের সঙ্গে সোমবার সকালে ফোনে কথা হয়েছে। এ সময় ছেলে বলেছেন, ‘মা, তোমরা যা চাইছ, আমি তা–ই করার চেষ্টা করছি। আমরা টাকাপয়সা চাইছি না। চাইছি ছেলে দেশের লাগি (জন্য), এলাকার লাগি সুনাম আনবো, এতেই আমরা খুশি।’
এই খুশির ঢেউ এখন করিমপুর গ্রামটিতেও। সবাই তাঁর এ সাফল্যে আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন। নীরব-নিঃশব্দে আনন্দের এ উচ্ছ্বাস এখন বাড়িজুড়ে, গ্রামের ভেতরে।
ছোট ভাই (ইকবাল হাসান ইমনের) আরিফুল ইসলাম সাগরেরও ক্রিকেটের প্রতি টান। কিন্তু দুই ভাইকে সমর্থন দেওয়ার মতো পরিবারের সামর্থ্য নেই। তারপরও আরিফুল ইসলাম তাঁর মতো করে চর্চা করছেন। তিনি বলেন, ‘ভাই (ইকবাল) অনেক কষ্ট করছে। আমি তার সঙ্গে একাডেমিতে যেতাম। আমরা বাড়ি থেকে দুই কিলোমিটার হেঁটে বড় সড়কে যেতাম। আবার শহরে গাড়ির স্ট্যান্ড থেকে একাডেমিতে আসা-যাওয়া করতে আরও দুই কিলোমিটার হাঁটতাম।’
ইকবাল হাসান ইমনের সম্পর্কে চাচা জাকির হোসেন বলেন, ‘আমি খেলা দেখছি, অনেক ভালা লাগছে। ভাতিজা জিতছে। অনেক গর্বের বিষয়।’ একই রকম খুশি ও গর্বের কথা শোনালেন সম্পর্কে চাচা আবদুল আউয়াল, সাগর হোসেন প্রমুখ। অনেক কাছ থেকে ইকবাল হাসান ইমনকে দেখেছেন ক্রিকেট সংগঠক গাজী আবেদ। তাঁরা একই ইউনিয়নেরই (মনুমুখ) বাসিন্দা।
করিমপুরে ইকবালদের বাড়িতে বসেই ক্রিকেট ক্লাব মাহাদী ইলেভেনের সভাপতি গাজী আবেদ সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘তার (ইকবাল হোসেন ইমন) এই সাফল্যের পেছনে তার মামা শাহ পারভেজ, জেলার কোচ রাসেল আহমদ ও আরেক কোচ নাজমুল হোসেনের অনেক অবদান আছে। তবে সবচেয়ে বেশি অবদান তার পরিবারের। এই জায়গায় যেতে প্রচুর কষ্ট করেছে সে।’
বেলা ততক্ষণে বেশ গড়িয়ে দুপুরের দিকে ছুটছে। কামারখালী পাড়ের বাড়িটির আশপাশের সবজিখেত, বোরো ধানের বীজতলাজুড়ে শীতমাখা রোদ ঝিলিক দিচ্ছে। সেই রোদের ঝিলিক যেন ইকবাল হাসান ইমনদের টিনের বাড়িটিকে আরও উজ্জ্বল করে তুলছিল।