নির্বাচনের আগে ‘চাঙা হচ্ছে’ সংসদ সদস্য–মেয়রের পুরোনো বিরোধ

রাজশাহী–৪ আসনের সংসদ সদস্য এনামুল হক ও তাহেরপুর পৌরসভার মেয়র আবুল কালাম আজাদ
ছবি: সংগৃহীত

রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায় আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য এনামুল হক ও তাহেরপুর পৌরসভার মেয়র আবুল কালাম আজাদের মধ্যে পুরোনো বিরোধ আবারও ‘চাঙা হয়ে উঠছে’। তাঁরা দুজনই আগামী সংসদ নির্বাচনে রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনে দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসায় ধীরে ধীরে তাঁদের বিরোধ প্রকাশ্যে আসছে।

সংসদ সদস্য এনামুল হক বাগমারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। পৌর মেয়র আবুল কালাম আজাদ উপজেলার তাহেরপুর পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। গত সংসদ নির্বাচনের আগে থেকে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে এই দুই নেতার বিরোধ চলে আসছে। গতকাল শনিবার উপজেলায় দুই নেতার অনুসারীদের পাল্টাপাল্টি ‘ঈদ পুনর্মিলনী’ অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে সেই বিরোধ আবারও প্রকাশ্যে এসেছে।

আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদ বাগমারা কমান্ডের ব্যানারে গতকাল শনিবার উপজেলা সদর ভবানীগঞ্জ ডাকবাংলো চত্বরে ‘ঈদ পুনর্মিলনী’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই পক্ষ মেয়র আবুল কালাম আজাদের অনুসারী। তাদের অনুষ্ঠানে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াদুদকে প্রধান অতিথি, সহসভাপতি জিনাতুন নেসা তালুকদার, ইব্রাহিম হোসেন, জাকিরুল ইসলাম, পি এম সফিকুল ইসলামকে বিশেষ অতিথি করে প্রচারণা চালানো হয়। অনুষ্ঠানে জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের একাংশের নেতাদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়।

তাহেরপুর পৌর মেয়র আবুল কালাম আজাদের অনুসারীদের আয়োজিত অনুষ্ঠানে জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা অংশ নেন। গতকাল বাগমারা ডাকবাংলো চত্বরে

এদিকে শুক্রবার রাতে মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদ বাগমারা কমান্ডের একাংশের সভাপতি সাইফুল ইসলাম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ভবানীগঞ্জ শহীদ মিনার চত্বরে পাল্টা ‘ঈদ পুনর্মিলনী’ অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন। তিনি সেখানে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের সন্তানদের উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ করেন। পক্ষটি স্থানীয়ভাবে সংসদ সদস্যের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সকালেই মেয়রের অনুসারীরা ডাকবাংলো চত্বরে ও সংসদ সদস্যের অনুসারীরা শহীদ মিনার চত্বরে অবস্থান নেন। উভয় পক্ষ পরস্পরের অনুষ্ঠানস্থলের দিকে মাইক ঝুলিয়ে বক্তব্য ও স্লোগান দেন। এতে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এ সময় পুলিশ সদস্যরা দুই অনুষ্ঠানস্থলের মাঝখানে অবস্থান নেয়। পুলিশ এ সময় শহীদ মিনার চত্বর থেকে প্রতিপক্ষের ওপর হামলার জন্য নিয়ে আসা এক ভ্যান ইটের টুকরা জব্দ করে।

সংসদ সদস্য এনামুল হকের অনুসারীদের অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। গতকাল ভবানীগঞ্জ শহীদ মিনার চত্বরে

শহীদ মিনারের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে সংসদ সদস্য এনামুল হক, বিশেষ অতিথি হিসেবে জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অনিল কুমার সরকারের নাম প্রচার করা হলেও তাঁরা উপস্থিত ছিলেন না। সেখানে বক্তব্য দেন উপজেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আবদুল মালেক মণ্ডল, মতিউর রহমান, সাধারণ সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, যুগ্ম সম্পাদক আসাদুজ্জামান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মমতাজ আক্তার, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল জব্বার প্রমুখ। তাঁরা বর্তমান সংসদ সদস্যের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ও তাহেরপুর পৌরসভার মেয়রের বিভিন্ন অনিয়মের চিত্র তুলে ধরেন। তাঁকে প্রতিহতেরও ঘোষণা দেন। এ ছাড়া উপজেলা নেতাদের না জানিয়ে বাগমারায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের আগমনের সমালোচনা করেন।

অপর দিকে ডাকবাংলোয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পৌর মেয়র আবুল কালাম আজাদ, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জাকিরুল ইসলাম ও পি এম সফিকুল ইসলাম। তাঁরা এ আসন থেকে বর্তমান সংসদ সদস্যকে মনোনয়ন না দেওয়ার দাবি জানান। সংসদ সদস্যকে প্রতিহতেরও ঘোষণা দিয়েছেন ওই অনুষ্ঠান থেকে। তাঁরা আওয়ামী লীগকে রক্ষার জন্য মাঠে নেমেছেন বলে বক্তব্যে উল্লেখ করেন। অনুষ্ঠানে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াদুদ উপস্থিত ছিলেন।

ভবানীগঞ্জ শহীদ মিনার চত্বর থেকে এক ভ্যান ইটের টুকরা জব্দ করে পুলিশ

মেয়রের পক্ষের অনুষ্ঠানের আয়োজক উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদের একাংশের সভাপতি জিয়াউদ্দিন বলেন, তাঁদের অনুষ্ঠানটি ছিল পূর্বনির্ধারিত ও প্রশাসনের অনুমতি নেওয়া। হঠাৎ সংসদ সদস্যের অনুসারীরা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে পাল্টা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এটি রুচিশীলতার পরিচয় বহন করে না।

অপর দিকে সংসদ সদস্যের পক্ষের অনুষ্ঠানের আয়োজক উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদ কমান্ডের আরেক অংশের সাধারণ সম্পাদক ফখরুদ্দীন আগা খান প্রথম আলোকে বলেন, মেয়রের সমর্থকেরা যে সংগঠনের নামে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন, তার কোনো বৈধতা নেই।

অনুষ্ঠান বিষয়ে বাগমারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি এক পক্ষের (মেয়রের) অনুষ্ঠান বিষয়ে জানতেন। পরে এখানে এসে আরেক পক্ষকে দেখেছেন। উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা থাকলেও পুলিশের তৎপরতার কারণে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।

তাহেরপুর পৌরসভার মেয়র আবুল কালাম আজাদ বলেন, তিনি কারও সঙ্গে বিরোধে জড়ান না। তাঁকে অনুষ্ঠান করতে দেওয়া হয় না। এ ছাড়া বর্তমান সংসদ সদস্যের সঙ্গে কোনো আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী নেই। তিনি দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগকে রক্ষার জন্য কাজ করবেন।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সংসদ সদস্য এনামুল হক বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাঁর এলাকায় অনুষ্ঠানে যাবেন, সে ব্যাপারে তাঁকে বা ভবানীগঞ্জ পৌরসভার সভাপতিকেও কিছু জানাননি। তিনি এর নিন্দা জানান।
দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে থেকে এনামুল হক ও আবুল কালাম আজাদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। ওই সময়ে মেয়রও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে প্রচারণা চালান। তখন উভয় পক্ষের মধ্যে একাধিকবার অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটে। শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন পান এনামুল হক। আবুল কালাম তাঁর পক্ষে সরাসরি প্রচারণায় নামলে বিরোধ স্তিমিত হয়। পরে আবুল কালাম আজাদ দলীয় মনোনয়নে তৃতীয়বার তাহেরপুর পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন।
আবারও নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসায় পুরোনো বিরোধ সামনে আসতে শুরু করেছে।

গত ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন উপলক্ষে উপজেলার যাত্রাগাছি মাদ্রাসা মাঠে মেয়র এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। তবে সংসদ সদস্যের অনুসারীরা সেখানে পাল্টা আরেকটি অনুষ্ঠান আহ্বান করায় মেয়রের অনুষ্ঠান বাদ হয়ে যায়। সংসদ সদস্য পরের দিন উপজেলার সোনাডাঙ্গায় একটি বিয়েবাড়িতে এসে উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সভা ডাকেন। ওই সভায় তাহেরপুর পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ ও সভাপতি আবু বাক্কার মৃধা মনছুর রহমানকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে গত ১৫ এপ্রিল জেলা আওয়ামী লীগ এ সিদ্ধান্ত ‘অগণতান্ত্রিক’ উল্লেখ করে তাঁদের স্বপদে বহাল করে।