নেত্রকোনায় জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে একটি বাড়িতে অভিযানের পর চারজনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা হয়েছে। গতকাল সোমবার দিবাগত রাত দুইটার দিকে নেত্রকোনা মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আনিছুর আশেকিন বাদী হয়ে মামলাটি করেন। এদিকে বাড়িটির মালিককে আসামি করা না হলেও তাঁকে পুলিশের নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
আজ মঙ্গলবার বিকেলে জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) মো. লুৎফর রহমান প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। মামলায় চারজনের নাম উল্লেখের পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে।
মামলার আসামিরা হলেন পিরোজপুরের নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠি) উপজেলার বালিহারি গ্রামের সেলিম মিয়ার ছেলে মো. হামিম হোসেন ওরফে ফাহিম ওরফে আনোয়ার আহমেদ ওরফে শাহজালাল ওরফে আরিফ (৩২), তাঁর স্ত্রী উম্মে হাফসা (২৫), সাতক্ষীরা সদর উপজেলার লাফসা ইউনিয়নের মাগুরা পূর্বপাড়া এলাকার নিজামুদ্দিনের ছেলে শফিকুল ইসলাম ওরফে আতিক (৩৭) এবং সাইফুল্লাহ (৪২) নামের এক ব্যক্তি। সাইফুল্লাহর ঠিকানা প্রাথমিকভাবে না জানা গেলেও মামলায় তাঁর শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার সুভাঢ্যা হাসনাবাদ উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর শ্বশুরের নাম আবদুল হাই।
৫ জুন নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মাহমুদাবাদ টানপাড়া এলাকার একটি যাত্রীবাহী বাস থেকে একে-২২ রাইফেলসহ গ্রেপ্তার হন হামিম হোসেন নামের এক ব্যক্তি। এরপর নেত্রকোনা সদর উপজেলার ভাসাপাড়া গ্রামের রহস্যঘেরা ওই বাড়ির সন্ধান পায় পুলিশ। এরপর শনিবার দুপুরে প্রথমে নেত্রকোনা মডেল থানা-পুলিশ ও গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) অভিযান চালায়। এরপর অ্যান্টিটেররিজম ইউনিট, ডিএমপির সোয়াট ও বোম ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যরা সেখানে অভিযান চালান। অভিযানে পিস্তল, বোমা, গুলি, ম্যাগাজিন, ডামি রাইফেলসহ জঙ্গি তৎপরতায় ব্যবহৃত মোট ৮০ ধরনের আলামত উদ্ধার করা হয়।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ওই বাড়ি জঙ্গিদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র হিসেবে পরিচালনা করতেন হামিম। তাঁর সঙ্গে কয়েকজন পুরুষ ও দুজন নারী ছিলেন। বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল বাইরের কয়েকজনের। পুলিশের অভিযান টের পেয়ে তাঁরা বাড়িটি ছেড়ে আগেই পালিয়ে যান।
তদন্তে নিয়োজিত পুলিশ ও এলাকার কয়েকটি সূত্র জানায়, গত শনিবার সকালে অভিযানে গিয়ে পুলিশ বাড়িটির রান্নাঘরে রান্না করা ভাত, ডিম ও মাংসের তরকারি দেখতে পায়। অভিযানের দু-এক দিন আগেও জঙ্গিরা সেখানে ছিল, এর মাধ্যমে নিশ্চিত হয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
প্রায় ২৪০ শতক জমির ওপর নির্মিত বাড়িটির মালিক ঢাকা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল মান্নান। অভিযান শেষে তাঁকে আসামি করা না হলেও তিনি পুলিশের নজরদারিতে আছেন। জঙ্গিদের সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতা ছিল কি না, সেটা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। এ ছাড়া তাঁর ভূমিকা নিয়ে স্থানীয় লোকজনের মধ্যেও নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
ভাসাপাড়া এলাকার এক বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, গার্লস কলেজের কথা বলে নির্মিত বাড়িতে গত ২০ বছরে কোনো কার্যক্রম শুরু হয়নি। এটি এলাকাবাসীর কাছে রহস্য। দুই থেকে আড়াই বছর আগে পিরোজপুরের হামিমের কাছে বাড়িটি ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারেও তাঁরা তেমন কিছুই জানতেন না। বাড়িতে কী ধরনের কার্যক্রম চলত, সে ব্যাপারে মান্নান কিছু জানতেন কি না, সে ব্যাপারেও কিছু জানা যায়নি।
একাধিকবার কল করেও গত শনিবার বিকেল থেকে আবদুল মান্নানের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। নেত্রকোনার পুলিশ সুপার মো. ফয়েজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, অভিযানের প্রথম দিন পর্যন্ত মান্নান পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু দ্বিতীয় দিন থেকে তাঁর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তাঁকে আসতে বলা হলেও তিনি আসেননি। তাঁকে পুলিশের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ তদন্তের পর তাঁর সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাবে। সম্পৃক্ততা মিললে অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে।
পুলিশ সূত্র জানায়, মান্নানের গ্রামের বাড়ি জেলার আটপাড়া উপজেলার নোয়াপাড়া এলাকায়। ভাসাপাড়া গ্রামের বাড়িটি ছাড়াও তাঁর জেলা শহরের বনোয়াপাড়া এলাকায় আরেকটি বাড়ি আছে। সেখানে মডার্ন ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি নামে তাঁর একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। নেত্রকোনায় তাঁর আরও কিছু জায়গাজমি, ফার্ম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকার তথ্য পেয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া গাজীপুরে জামিয়া সাবিলুর কওমি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি প্রতিষ্ঠাতা। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে নজরদারিতে রেখেছে পুলিশ।