বাগেরহাটে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে ভারী বৃষ্টি, ঝোড়ো বাতাস ও উঁচু জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস কাটিয়ে তিন দিন পর রোদের দেখা মিলেছে। তবে আজ মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় রয়েছে জেলার অধিকাংশ এলাকা। শহরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হলেও অনেক এলাকা ৪৮ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বিদ্যুৎ–বিচ্ছিন্ন রয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, ঘূর্ণিঝড়ে সঞ্চালন লাইনের ওপর গাছপালা পড়ে ও বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যুতের অভাবে মুঠোফোনসহ প্রয়োজনীয় ডিভাইস সচল রাখতে না পেরে যোগাযোগ ও প্রয়োজনীয় কাজে বিঘ্ন ঘটছে। দুর্বল হয়ে পড়েছে মোবাইল নেটওয়ার্কও। আজ সকালেও বিভিন্ন এলাকায় পানিবন্দী রয়েছে কয়েক হাজার পরিবার। কিছু এলাকা থেকে পানি নেমে গেলেও ঘর থেকে রান্নার চুলা সবই ভিজে আছে। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে কিছু এলাকায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয় লোকজন।
প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর গতকাল সোমবার রাতে বাগেরহাট পৌরশহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়। শহরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (ওজোপাডিকো) নির্বাহী প্রকৌশলী জিয়াউল হক বলেন, গতকাল দুপুরেই বিদ্যুৎ সরবরাহ আবার শুরু হয়। তবে বারবার লাইন ট্রিপ ও ঝোড়ো বাতাসের সরবরাহে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। ঝড়বৃষ্টির মধ্যেও কাজ করে তাঁরা দ্রুত সময়ের মধ্যে সঞ্চালন স্বাভাবিক করতে পেরেছেন।
তবে এখনো আরও অনেক গ্রাহকের সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। সার্ভিস তার ছিঁড়ে যাওয়ায় এবং মিটার ভেঙে যাওয়ায় তাঁদের লাইন চালু করতে সময় লাগছে। ঝড়ে আটটি বৈদ্যুতিক পোল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বাগেরহাটে সবচেয়ে বেশি গ্রাহককে বিদ্যুৎসেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠান পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। জেলায় তাদের প্রায় পাঁচ লাখ গ্রাহক রয়েছে। প্রাথমিক হিসাবে প্রতিষ্ঠানটির প্রায় অর্ধশত বৈদ্যুতিক পোল ভেঙে পড়েছে এবং হেলে পড়েছে ৮৬টি। তার ছিঁড়েছে অন্তত ৭০২টি স্থানে। এ ছাড়া প্রায় ৪০০টি মিটার ভেঙেছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৫টি ট্রান্সফরমার।
জেলাটিতে সবচেয়ে বেশি গ্রাহককে বিদ্যুৎসেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠান পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে। জেলায় তাদের প্রায় পাঁচ লাখ গ্রাহক রয়েছে। প্রাথমিক হিসাবে প্রতিষ্ঠানটির প্রায় অর্ধশত বৈদ্যুতিক পোল ভেঙে পড়েছে এবং হেলে পড়েছে ৮৬টি। তার ছিঁড়েছে অন্তত ৭০২টি স্থানে। এ ছাড়া প্রায় ৪০০টি মিটার ভেঙেছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৫টি ট্রান্সফরমার।
এখনো সব এলাকায় পৌঁছাতে না পারায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেতে পারে বলে জানান জেলার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক সুশান্ত রায়। তিনি বলেন, দ্রুতই সব এলাকায় সরবরাহ স্বাভাবিক হবে। আজ সকাল ১০টা পর্যন্ত ৪ লাখ ৮৫ হাজার গ্রাহকের মধ্যে ৪০ হাজার গ্রাহককে বিদ্যুৎসেবার আওতায় আনা গেছে।
ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে তীব্র ঝোড়ো বাতাস, ভারী বৃষ্টি ও উঁচু জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসে কৃষকেরা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছেন। জেলায় কৃষক ও মাছচাষিদের ক্ষতি ১০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বাগেরহাট কার্যালয়ের উপপরিচালক শংকর কুমার মজুমদার আলোকে বলেন, মাঠে ধান না থাকলেও পাট, আউশ ধানের বীজতলা, কলা-পেঁপেসহ বিভিন্ন প্রকার ফল, সবজি, পান, আখসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিক হিসাবে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে এসব ফসলের ১১ হাজার ৫৮১ হেক্টর জমি আক্রান্ত হয়েছে। গতকালও বৃষ্টি ছিল, আজ হয়তো পানি নামতে শুরু করবে। এরপর ক্ষতির প্রকৃতি চিত্র পাওয়া যাবে।
মাঠে ধান না থাকলেও পাট, আউশ ধানের বীজতলা, কলা-পেঁপেসহ বিভিন্ন প্রকার ফল, সবজি, পান, আখসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিক হিসাবে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে এসব ফসলের ১১ হাজার ৫৮১ হেক্টর জমি আক্রান্ত হয়েছে। গতকালও বৃষ্টি ছিল, আজ হয়তো পানি নামতে শুরু করবে। এরপর ক্ষতির প্রকৃতি চিত্র পাওয়া যাবে।কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বাগেরহাট কার্যালয়ের উপপরিচালক শংকর কুমার মজুমদার
লবণাক্ততার কারণে জেলার দক্ষিণের উপজেলাগুলোয় ধানের আবাদ কম। এখানে মানুষের প্রধান জীবিকা মাছ চাষ। উঁচু জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসের পানিতে জেলার প্রায় অর্ধেক মৎস্যঘের তলিয়ে গেছে মাছ। এতে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন চাষিরা। জেলার কচুয়া উপজেলার ভান্ডারখোলা এলাকার মাছচাষি ইলিয়াছ আহমেদ বলেন, ‘ঘেরে মাছ চাষ করি আর পাড়ে সবজি। ঘের তো ভসিছে, পাড়ের সবজিও সব শেষ। কয় দিন আগে মাছ ছাড়লাম। সব শেষ।’
ঘের ভেসে বেশি ক্ষতি হয়েছে মোরেলগঞ্জ, রামপাল ও মোংলা উপজেলায়। মোরেলগঞ্জ উপজেলার বহরবুনিয়া ইউনিয়ন ঝড়ে রাতে পুরোটাই চলে যায় পানির নিচে। এখানে বসতঘর থেকে শুরু করে ঘেরের মাছ সবই ভেসে গেছে।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ এস এম রাসেল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, বাগেরহাটের ৯ উপজেলাতেই মাছের ঘের রয়েছে, যার সংখ্যা ৭৪ হাজার। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে টানা বৃষ্টি ও জোয়ার-জলোচ্ছ্বাসে এরই মাছে ৩৫ হাজার ঘের তলিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এতে প্রায় ৭৫ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।
ঝড়ে জেলার ৭৫টি ইউনিয়নের সব কটিই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। তাদের প্রাথমিক হিসাবে বিভিন্ন এলাকায় ১০ হাজারের বেশি কাঁচাপাকা বাড়িঘর সম্পূর্ণ এবং ৩৫ হাজার আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রশাসনের হিসাবে জেলায় দুর্গত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে উঁচু জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসে বাগেরহাটের তিন উপজেলার অন্তত পাঁচটি এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়েছে। এর মধ্যে মোরেলগঞ্জ উপজেলার বলইবুনিয়ার শ্রেণিখালী এলাকায় পানগুছী নদীতীরবর্তী দৈবজ্ঞহাটি উপপ্রকল্পের দুটি স্থানে ১০ মিটার ও একই নদীর পঞ্চকরণের দেবরাজ ও কুমারিয়াজোলা এলাকায় ৪০০ মিটার, শরণখোলা উপজেলার রায়েন্দা খালের রাজৈর এলাকায় ৩৫/১ পোল্ডারের ৮০ মিটার এবং বাগেরহাট সদর উপজেলার ভৈরব নদের তীরবর্তী গোপালকাঠি এলাকার নাজিরপুর উপপ্রকল্পের ৪০ মিটার ও দড়াটানা নদীর বিষ্ণুপুর এলাকার বেমরতা উপপ্রকল্পে ৬ মিটার বাঁধ জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসের পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া বাগেরহাট সদর, মোরেলগঞ্জ, মোংলা ও রামপাল উপজেলায় বাঁধের বাইরে থাকা বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
শরণখোলার তাফালবাড়ি এলাকার নাজমুল বলেন, ‘গতকাল রাত থেকে সকাল পর্যন্ত একটানা বাতাস হচ্ছে। এই বাতাসে আমাদের বেশ কিছু গাছ পড়ে গেছে। আমাদের এলাকা বিদ্যুৎ–বিচ্ছিন্ন রয়েছে। সব সময় মুঠোফোনের নেটওয়ার্কও পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক এলাকাতেই খাবার ও পানির সংকট দেখা যাচ্ছে।’