নোয়াখালী থেকে আসে হোগলাপাতা, নওগাঁ থেকে জলপাতা। সঙ্গে যুক্ত হয় পাটের আঁশ। বানানো হয় মোটা শক্ত রশি। সেই রশিতে তৈরি হয় দৃষ্টিনন্দন সব কারুপণ্য। এসব পণ্যের মধ্যে আছে ঝুড়ি, মোড়া, ল্যাম্পশেড, পাপোশ। হাতে তৈরি এসব কারুপণ্যের কারিগরদের বাড়ি রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দে। পায়রাবন্দের নারীদের তৈরি এসব কারুপণ্য দেশের বাজারে বিক্রি হচ্ছে, বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে।
হস্তশিল্পের এ কাজ করে চার গ্রামের শতাধিক নারী হয়েছেন স্বাবলম্বী। পরিবারে এনেছেন সচ্ছলতা। নারীদের নীরব এই কর্মচাঞ্চল্য নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার পায়রাবন্দে। তিন বছর ধরে নারীদের বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন যিনি, তাঁর নাম রেজাউল করিম (৪৩)।
অভাবের সংসারে পড়াটা খুব বেশি দূর এগোয়নি রেজাউলের। কলেজের সীমানায় পা পড়ার আগেই সংসারের হাল ধরতে পাড়ি জমান ঢাকায়। ২০০০ সালের দিকে চাকরি নেন একটি হস্তশিল্প কারখানায়। বছর পাঁচেক কাজ করেন সেখানে। পরে বিভিন্ন এনজিওতে কাজ করেছেন। ২০১৩ সালের দিকে নিজেই একটি কারখানা দেন। করোনা মহামারিতে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। পুঁজি হারিয়ে গ্রামের বাড়িতে ফেরেন শূন্য হাতে। কী করবেন দিশা পাচ্ছিলেন না রেজাউল। দেড় লাখ টাকায় জমি বন্ধক রাখেন।
ঢাকায় বন্ধ হয়ে যাওয়া কাজ গ্রামের বাড়িতে বসে শুরু করেন। শুরুতে অনেকে তাচ্ছিল্য করেছিল। কিন্তু রেজাউল দমেননি। বাড়ি বাড়ি ঘুরে নারীদের বোঝালেন। সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে তাঁদের কারুপণ্য তৈরির প্রশিক্ষণ দিলেন। প্রশিক্ষণ পাওয়া নারীদের দিয়েই শুরু করলেন ‘আরকে হ্যান্ডিক্র্যাফটস’র যাত্রা।
এই কারখানা থেকে এখন রাজধানীর দুটি, রংপুরের একটি প্রতিষ্ঠানে পণ্য সরবরাহ করা হয়। স্থানীয় বাজারে কিংবা খোলাবাজারে এসব পণ্য বিক্রি হয় না। এই তিন প্রতিষ্ঠানের চাহিদামতো পণ্য বিদেশে রপ্তানি করা হয়, জানালেন রেজাউল।
প্রতি মাসে তিন প্রতিষ্ঠানে ১৫ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করা হয়। সেই হিসাবে, বছরে পৌনে দুই কোটি টাকার কারুপণ্য বিক্রি হচ্ছে এই পায়রাবন্দ থেকেই। চাহিদা থাকায় দুই মাসের মধ্যে বিক্রি আরও বাড়বে বলে আশাবাদী রেজাউল।
পরিবারে স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছে তাঁর। মা মারা গেছেন, বাবা আবদুর রহিম তাঁর সঙ্গেই থাকেন। রেজাউল বলেন, ‘শক্ত মনোবল ছিল বলেই হাল ছাড়িনি। বিনা মূল্যে নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি। তাঁরা কেউ বাড়িতে, কেউ কারখানায় এসে কাজ করেন।’
রেজাউল সম্পর্কে পায়রাবন্দ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান ফয়জার রহমান খান বলেন, তাঁর হাত ধরে অনেকেই আজ স্বাবলম্বী। এভাবে আরও অনেকে এগিয়ে এলে এই গ্রাম একদিন আরও আলোকিত হয়ে উঠবে।
রংপুর শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার দক্ষিণে পায়রাবন্দ ইউনিয়ন। পায়রাবন্দ বাজারের লাগোয়া খোর্দ্দমুরাদপুর গ্রামে বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র। সেখানে বেগম রোকেয়ার ভাস্কর্য ও একটি পাঠাগার আছে। স্মৃতিকেন্দ্রের দক্ষিণ পাশের রাস্তা পার হলেই দেবীপুর গ্রাম শুরু। সেখানেই রেজাউলের কারখানা। খোর্দ্দমুরাদপুর ও দেবীপুর ছাড়াও কারখানাটিতে ইসলামপুর ও জয়রামপুর গ্রামের নারীরা কাজ করেন।
১ নভেম্বর সরেজমিনে দেখা যায়, প্রায় ১০ শতাংশ জমির ওপর একটি টিনশেডের কারখানায় নারীরা কাজ করছেন। কেউ তৈরি করছেন ল্যাম্পশেড, কেউবা রান্নাঘরের ঝুড়ি। ঘরে কাপড় রাখা, বর্জ্যের ঝুড়ি, পাপোশও তৈরি হচ্ছে। টিনশেড ঘরটির জন্য মাসে সাত হাজার টাকা ভাড়া দেন রেজাউল।
কথা হয় খোর্দ্দমুরাদপুর গ্রামের লাকী বেগমের (৩০) সঙ্গে। বড়সড় একটা ঝুড়ি বানাচ্ছিলেন তিনি। বললেন, স্বামী আবদুর রাজ্জাক অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করেন। সংসারে দুই ছেলেমেয়ে। বড় ছেলেটি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। কারখানায় ছয় মাস ধরে নিয়মিত কাজ করছেন। এর আগে তিনি বিনা মূল্যে বিভিন্ন পণ্য তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়েছেন রেজাউলের কাছে। এখানে কাজ করে মাস শেষে পাঁচ হাজার টাকা পান। সকাল ১০টায় কাজ শুরু হয়। দুপুরে এক ঘণ্টা বিরতি দিয়ে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কাজ চলে। লাকী বেগম জানালেন, বাড়িতে নিয়ে রাতে কাজ করতে পারলে আরও বেশি উপার্জন করতে পারতেন।
লাইজু বেগম (৪২) ও তাঁর স্বামী মাহফুজার রহমান (৫৩) তাঁরা দুজনে মিলে কারখানায় কাজ করেন। এক দিনে দুই থেকে আড়াই ফুট লম্বা তিনটি ঝুড়ি তৈরি করতে পারেন বলে জানালেন লাইজু। বললেন, ‘এটে আট মাস থাকি কাজ করিছি। এই কাজে পারদর্শী করে তুলতে বিনে পয়সায় প্রশিক্ষণ দিছে। দুজন মিলে মাসে প্রায় ১০ হাজার টাকা আয় হয়। সেই টাকায় হামার সংসার ভালোই চলছে।’
রেজাউলকে কাছ থেকে দেখেছেন পায়রাবন্দের রোকেয়া স্মৃতি পাঠাগারের উদ্যোক্তা রফিকুল ইসলাম। তিনি বললেন, ‘কীভাবে নারীদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা যায়, রেজাউল তার উদাহরণ। তিনি প্রথম যখন শুরু করেন, তখন সবাই তাঁকে তাচ্ছিল্য করেছিল। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি।’