সারা দেশে দলের কাউন্সিলর পদের প্রার্থীদের ঠেকাতে বিএনপিকে নানা কৌশলের আশ্রয় নিতে হচ্ছে।
বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আসন্ন পাঁচ সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে দলটির প্রার্থীদের তোড়জোড় না থাকলেও কাউন্সিলর পদে বিএনপির অনেকে নির্বাচনের মাঠে রয়েছেন। সারা দেশে দলের কাউন্সিলর পদের প্রার্থীদের ঠেকাতে দলটিকে নানা কৌশলের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। কাউন্সিলর পদে অংশ নেওয়ায় গাজীপুরে দলের ২৯ নেতাকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। সিলেটে কাউন্সিলর পদে প্রার্থী না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে দলের ৩২ নেতাকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
এ ক্ষেত্রে খুলনা বিএনপি অনেকটা স্বস্তিতে রয়েছে। খুলনায় কাউন্সিলর পদেও দলটির পদধারী মাত্র দুজন নেতা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তবে শেষ পর্যন্ত থাকা নিয়ে তাঁরাও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত চারটি কারণে খুলনায় বিএনপির নেতাদের কাউন্সিলর পদে দেখা যাচ্ছে না। প্রথমত, বছর দেড়েক আগে নগর বিএনপির নতুন নেতৃত্ব এসেছে। নতুন নেতারা তাঁদের মতো করে বিএনপিকে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে, থানায় থানায় নতুন কমিটি করার প্রক্রিয়া চলমান। গতবার হেরে যাওয়া কাউন্সিলর প্রার্থীদের কয়েকজন নতুন কমিটিতে রয়েছেন। নতুন কমিটির সঙ্গে থাকা নেতা-কর্মীরা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ঝুঁকিতে ফেলতে চাচ্ছেন না।
দ্বিতীয়ত, গত নির্বাচনে বিএনপির হয়ে অংশ নেওয়া কাউন্সিলর প্রার্থীদের কয়েকজন আবার দল ছেড়েছেন। আবার তাঁদের বড় একটা অংশ দলটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জুর অনুসারী। নজরুলের অনুসারীরা এখন আর খুলনা বিএনপির কোনো পদে নেই। নজরুলের অনুসারীদের মধ্যে বর্তমানে দলের কোনো পদে না থাকা বর্তমান কাউন্সিলর শমসের আলী ও মাজেদা খাতুন এবং ২২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব কায়সার নির্বাচনের মাঠে রয়েছেন। তবে বর্তমান বিএনপির কমিটির মতে, তাঁরা দলের কেউ নন।
তৃতীয়ত, গত খুলনা সিটি নির্বাচনে বিএনপির সমর্থন নিয়ে কাউন্সিলর হওয়ার পর ছয়জন কাউন্সিলর আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এ ছাড়া বিএনপির সমর্থন পেয়ে পরে বহিষ্কার হয়ে জেতা একজন কাউন্সিলরও আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ওই সাতজনের বেশির ভাগই একাধিকবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। এবারও তাঁরা সবাই নির্বাচনী মাঠে আছেন। ওই সাত বিএনপি নেতার সরকারি দলে যোগ দেওয়া এখন বিএনপির জন্য শাপে বর হয়েছে। বিএনপির অনেক নেতা মনে করেন, তাঁরা দলে থাকলে নিজেদের ‘জনপ্রিয়তার’ কথা বলে নির্বাচনী মাঠে থাকতেন।
চতুর্থ কারণ হলো নির্বাচনী পরিবেশ। বিএনপির নেতা-কর্মীরা নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে শঙ্কিত। কম করে পাঁচজন নেতা বলেছেন, অতীত অভিজ্ঞতায় সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া নিয়ে তাঁরা শঙ্কায়। নির্বাচন যদি সুষ্ঠু না হয়ে কারচুপির হয়, তখন তাঁদের দলের পদ ও আর্থিক ক্ষতি দুইই হবে। এটা মাথায় রেখে তাঁরা নির্বাচনে যাচ্ছেন না।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কেসিসিতে প্রথম নির্বাচন হয় ১৯৯৪ সালে। এরপর গত ২৯ বছরের পাঁচটি নির্বাচনে মেয়র পদে তিনবারই জয়ী হয়েছে বিএনপি। অন্য দুবার তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হেরেছেন দলটির নেতারা। এবার মেয়র পদে দলটির কোনো প্রার্থী নেই। গত নির্বাচনের মেয়র প্রার্থী বিএনপির সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম প্রার্থী হতে পারেন, এ রকম জল্পনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তিনি মনোনয়ন ফরম কেনেননি।
এদিকে সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে ৩১ ওয়ার্ডের মধ্যে ১২টিতে আওয়ামী লীগ ও ৯টিতে বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী জয়ী হন। বাকি ১০ ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও নির্দলীয় প্রার্থী কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। এ ছাড়া ১০ জন সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলরের মধ্যে বিএনপির ছিলেন একজন।
দল ত্যাগের পর বর্তমানে এক নারীসহ বিএনপির কাউন্সিলর আছেন চারজন। তাঁরা হলেন ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের মো. হাফিজুর রহমান, ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের আশফাকুর রহমান, ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের মো. শমসের আলী ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর মাজেদা খাতুন।
২৪ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর মো. শমসের আলী বলেন, ‘দলে বর্তমানে পদ নেই। তবে বিএনপি একটি জনমুখী দল। জনগণের চাওয়াকে বরাবরই প্রাধান্য দেয়। আমি টানা দুবারের কাউন্সিলর। জনগণের চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে কঠিন পরিস্থিতিতেও নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
দলীয় সূত্র জানায়, চার কাউন্সিলরের মধ্যে বর্তমানে পদে আছেন ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের দুবারের কাউন্সিলর মো. হাফিজুর রহমান এবং ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের তিনবারের কাউন্সিলর আশফাকুর রহমান। তাঁরা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য। উভয়ই আসন্ন সোনাডাঙ্গা থানা সম্মেলনে আহ্বায়ক পদে প্রার্থী হয়েছেন। আশফাকুর রহমান মনোনয়নপত্র জমা দিলেও হাফিজুর রহমান ফেসবুকে লিখেছেন, ‘প্রিয় এলাকাবাসী, আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন। দলের শৃঙ্খলা ও দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য আমি নিজেকে বিসর্জন দিলাম।’
মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া দলের পদধারী নেতা আশফাকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখনো প্রত্যাহার করার সময় আছে। একদিকে দলীয় সিদ্ধান্ত, অন্যদিকে জনগণ আমাকে ছাড়তে চাচ্ছে না। আবার নির্বাচন কমিশনের প্রতি আমি সন্দিহান। তাঁরা সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বললেও মাঠে সে ধরনের অবস্থা দেখতে পাচ্ছি না। আমার লোকজন নামতে পারছেন না। ভোটে কারচুপি হলে আম-ছালা দুটো হারানোর অবস্থায় পড়তে হবে।’
৫ নম্বর ওয়ার্ডের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া দলের অন্য পদধারী নেতা নগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সাজ্জাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে তিনবার নির্বাচন করে দলের স্থানীয় নেতাদের কারণে হেরেছি। এবার জনগণের চাপে প্রার্থী হয়েছি। দল যে সিদ্ধান্ত নেয় নেবে।’
দলীয় সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দিয়ে সরে দাঁড়ানো ৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির আহ্বায়ক শেখ আনছার আলী বলেন, ‘মনোনয়ন ফরম কিনলেও শেষ পর্যন্ত দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারিনি। ফরম জমা দিইনি।’
মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক শফিকুল আলম বলেন, ‘এই সরকারের অধীনে বিএনপি কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। খুলনায় পদধারী নেতা নির্বাচন করছে না বললেই চলে। তারপরও কেন্দ্র থেকে আমাদের কাছে সিদ্ধান্ত অমান্যকারীদের নামের তালিকা চেয়েছে। আমরা যাচাই–বাছাই করে তা শিগগিরই কেন্দ্রে পাঠালে, কেন্দ্র ব্যবস্থা নেবে।’