বিনা মূল্যে সিম কার্ড দেওয়ার কথা বলে তিন যুবক গ্রামে এসে লোকজনের আঙুলের ছাপ, চোখের মণির ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে যান।
শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা লিটন হাওলাদার এখন ইতালিপ্রবাসী। গত ১৬ জানুয়ারি তাঁর ইমো (অডিও-ভিডিও কলিং ও তাৎক্ষণিক ক্ষুদেবার্তা আদানপ্রদানের অ্যাপ) আইডি হ্যাক করে একটি প্রতারক চক্র।
চক্রের সদস্যরা লিটনের আইডি থেকে তাঁর চাচাতো ভাই আবু কালাম হাওলাদারকে (৫২) বার্তা পাঠিয়ে টাকা পাঠাতে বলেন। এভাবে প্রতারক চক্র আবু কালামের কাছ থেকে দুই দফায় ৬০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। আবু কালাম পরে প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে ভেদরগঞ্জ থানায় মামলা করতে যান। পুলিশ মামলা নেয়নি। পরে ২৪ জানুয়ারি আদালতে একটি মামলার আবেদন করেন।
আদালতের বিচারক সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রুমানা আক্তার ২৯ জানুয়ারি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) ওই তদন্তের নির্দেশ দেন। সিআইডির উপপরিদর্শক মজিবুর রহমান প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত সিম ও মুঠোফোনে আর্থিক সেবার (এমএফএস) হিসাবগুলোর তথ্য সংগ্রহ করেন। দেখেন, এগুলো দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার দুজন শিক্ষক, একজন ভিক্ষুক, একজন কৃষক ও একজন হতদরিদ্র বিধবা নারীর নামে নিবন্ধিত। সিআইডি ওই সাতজনের নামে নোটিশ পাঠিয়ে শরীয়তপুর সিআইডি কার্যালয়ে হাজির হতে বলা হয়েছে। ওই নোটিশ পাওয়া ব্যক্তিরা এখন আতঙ্কিত।
তাঁদের একজন চিরিরবন্দরের বাসুদেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জান্নাতুল ফেরদৌস (৩০) প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছরের আগস্টে আমাদের বাড়ির আঙিনায় বসে তিন যুবক একটি মুঠোফোন কোম্পানির সিম কার্ড বিনা মূল্যে দিচ্ছিলেন। অন্যদের সঙ্গে আমিও একটি সিম নিই।
যুবকেরা আঙুলের ছাপ, চোখের মণির ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়েছেন। গত জুলাইয়ে থানা থেকে আমাকে নোটিশ করা হয়, আমার সিম দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। মামলা হয়েছে। এখন আমি আতঙ্কিত।’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শরীয়তপুর সিআইডির উপপরিদর্শক মজিবুর রহমান গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, প্রতারনার ঘটনায় তিন ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তাদের নাম উল্লেখ করে মামলার অনুসন্ধান প্রতিবেদন অনুমোদনের জন্য আগষ্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকায় সিআইডির অতিরিক্ত মহাপরিদর্শকের কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন হয়ে আসলে আদালতে জমা দেওয়া হবে।
ভেদরগঞ্জের বাঐকান্দি গ্রামের কৃষক আবু কালাম হাওলাদার ইতালিপ্রবাসী চাচাতো ভাই লিটনের কাছে বিভিন্ন সময় টাকা ধার নিতেন। লিটনও কখনোসখনো তাঁর কাছে টাকা ধার নেন। এসব ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে যাঁরা হুন্ডির ব্যবসা করেন, এমন ব্যক্তির মাধ্যমে তাঁরা টাকা লেনদেন করেন।
দুজনে কথা বলার সময় ইমো ব্যবহার করেন। ঘটনার দিন লিটনের ইমো আইডি থেকে প্রথমে আবু কালামের কাছে একটি বার্তা আসে। সেখানে সমস্যার কথা জানিয়ে একটি এমএফএস নম্বর দিয়ে দ্রুত ৩০ হাজার টাকা পাঠাতে বলা হয়। আবু কালাম নিশ্চিত হতে লিটনকে ইমোতে কল করলে অপর প্রান্ত থেকে কল কেটে দেওয়া হয়। একটি ভয়েস বার্তা দিয়ে বলা হয়, তিনি ব্যস্ত আছেন, কল ধরতে পারবেন না। ভয়েস বার্তায় লিটনের ‘কণ্ঠ’ শুনে আবু কালাম নির্দ্বিধায় টাকা পাঠিয়ে দেন। তবে ওই কণ্ঠ লিটনের ছিল না। প্রতারক চক্র বিশেষ একটি অ্যাপ ব্যবহার করে লিটনের কণ্ঠ নকল করে ওই বার্তা পাঠায়।
পর দিন লিটনের ইমো আইডি থেকে আবার ভয়েস বার্তা পাঠিয়ে আরও ৩০ হাজার টাকা পাঠাতে বলা হয়। এবার ভয়েস বার্তায় উল্লেখ করা হয়, তিনি ভিসা জটিলতায় ইতালি পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন। আবু কালাম যেন দ্রুত টাকা পাঠান। আবু কালাম এবার আরেকটি নম্বরে সেই টাকা পাঠিয়ে দেন।
আবু কালাম হাওলাদার বলেন, ‘পুলিশি ঝামেলার কথা শুনে লিটনের ফোন নম্বরে সরাসরি ফোন দিই। লিটন ফোনও ধরে। এরপর কথা শুনে আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। লিটনের ভিসা সমস্যাও হয়নি, সে টাকাও চায়নি। বুঝতে পারি, প্রতারক চক্রের ফাঁদে পা দিয়েছি।’
সিআইডি সূত্র জানায়, আবু কালামের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় মোট সাতটি সিম কার্ড ব্যবহৃত হয়েছে। এগুলো একই মুঠোফোন অপারেটরের নম্বর। সিআইডি প্রতারকদের দেওয়া দুটি নম্বরের সিম নিবন্ধন ও এমএফএস হিসাবের তথ্য সংগ্রহ করে দেখেন, একটি সিম নিবন্ধন ছায়দা বেগমের নামে, আর ওই নম্বরে এমএফএস হিসাব খোলা তাহেরা খাতুন নামে আরেক নারীর নামে। প্রতারক চক্র ওই নম্বর থেকে যে নম্বরে টাকা সরিয়েছেন, ওই সিমটি নিবন্ধন করা ফাতেমা খাতুনের নামে। আবার সেই নম্বরে এমএফএস হিসাব খোলা জান্নাতুল ফেরদৌস নামের এক নারীর নামে।
আরেকটি নম্বরের তথ্যে দেখা যায়, সিমটির নিবন্ধন সাখাওয়াত হোসেনের নামে। আর এমএফএস হিসাব আয়েশার নামে। আর যে নম্বরে টাকা সরানো হয়েছে, সেটি সম্পা আক্তার নামে আরেক নারীর নামে নিবন্ধিত ও এমএফএস হিসাবও একই নামে খোলা।
এই সাত ব্যক্তির ঠিকানা দেওয়া চিরিরবন্দরের অমরপুর ইউনিয়নের বড় শ্যামনগর গোতামারি পাড়া গ্রাম। সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তার নোটিশ পেয়ে কয়েকজন শরীয়তপুরে হাজিরও হন। কয়েকজনকে মুঠোফোনে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্ত কর্মকর্তা। বাকিদের বাড়িতে চিরিরবন্দর থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) সুলতান বাদশাকে পাঠিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
সিআইডি ওই নম্বরগুলো অনুসন্ধান করে দেখে জানতে পারে, এগুলো ব্যবহার করা হয়েছে নাটোরের লালপুর ও রাজশাহীর বাঘা উপজেলা থেকে। নম্বরগুলো থেকে কখনো কল করা হয়নি। কেবল বার্তা পাঠানো ও টাকা তোলা হয়েছে।
গত ৩১ আগস্ট সকালে চিরিরবন্দরের গোতামারি এলাকায় গেলে প্রথমে আতঙ্কে কথা বলতেও চাননি নোটিশ পাওয়া লোকজন। পরে গ্রাম পুলিশ আজিমউদ্দিনের সহযোগিতায় কথা শুরু হয় কয়েকজনের সঙ্গে। মুহূর্তে সেই উঠোনে ছুটে আসেন শতাধিক নারী-পুরুষ।
বলতে থাকেন বিনা মূল্যে সিম নেওয়ার কথা। সবার সিম নেওয়ার তারিখ ২০২২ সালের ১১ আগস্ট। গ্রামবাসী জানান, ওই দিন তাঁদের গ্রামে তিন যুবক এসে এক শিক্ষিকার বাড়িতে ছাতা-চেয়ার-টেবিল পেতে বসে। সেখানে একটি মুঠোফোন কোম্পানির সিম বিনা মূল্যে দিচ্ছিলেন তাঁরা। সঙ্গে ইন্টারনেট ও টকটাইমের কথা বলা হয়। ওই যুবকেরা সবার আঙুলের ছাপ, চোখের মণির ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়েছে।
ওই দিন সিম নেওয়া ভিক্ষুক ছায়দা বেগমের (৫৫) স্বামী নেই। সন্তানও নেই। ছোট একটি ঘরে থাকেন। মাঝেমধ্যে বোনের বাড়িতেও রাত কাটে তাঁর। গত ২৯ জুলাই পুলিশ ছায়দার খোঁজ করতে গ্রামে আসে। পুলিশ তাঁকে জানায়, শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ থানায় তাঁর নামে একটি প্রতারণা মামলা হয়েছে। তাঁর নামে নিবন্ধন করা মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
৩১ আগস্ট গোতামারি পাড়ায় দেড় শতাধিক লোক বিনা মূল্যে সিম নেওয়ার জন্য জড়ো হলেও সিম কার্ড দেওয়া হয় ৭৪ জনকে। আঙুলের ছাপ মিলছে না, সার্ভারে সমস্যা—এমন কথা বলে বাকিদের সিম দেওয়া হয়নি। তবে সবার আঙুলের ছাপ, চোখের মণির ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়েছে যুবকেরা।
এদিকে একের পর এক অভিযোগ পাওয়া শুরু হলে থানা-পুলিশ সবাইকে একসঙ্গে একটি লিখিত অভিযোগ দিতে বলে। সিম কার্ড কিনে প্রতারণার শিকার হয়েছেন এমন অভিযোগে গোতামারি পাড়ার ৭৪ জন ব্যক্তি স্বাক্ষরিত একটি অভিযোগ সম্প্রতি চিরিরবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) কাছে দেওয়া হয়েছে।
ওসি বজলুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। তবে মানুষের এ ব্যাপারে সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই। ভুক্তভোগীদের সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে বলেছি। সেই সঙ্গে ওই সব সিম কার্ডের নিবন্ধন বাতিল এবং এমএফএস হিসাব বন্ধ করার পরামর্শ দিয়েছি।’