১৫-২০ জনের একটি দল রামদা হাতে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’এবং বিএনপিবিরোধী স্লোগান দিচ্ছেন। কখনো ‘ধর ধর’ বলে অস্ত্র হাতে দৌড়াচ্ছেন, আবার কখনো একসঙ্গে সবাই অস্ত্র উঁচিয়ে ধরে তা মুঠোফোনে ভিডিও করছেন। গত সোমবার রাতে ফেসবুকে ‘ফরিদা ইয়াসমিন নূপুর’ নামের একটি আইডি থেকে সরাসরি প্রচার করা চারটি ভিডিওতে এমন দৃশ্য দেখা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফরিদা ইয়াসমিন নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতা ইউনিয়ন যুব মহিলা লীগের সভাপতি এবং ওই ইউনিয়নের ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী সদস্য। ভিডিওগুলোতে ওই নারী ইউপি সদস্যকেও রামদা হাতে দেখা গেছে। আজ বিকেল চারটার দিকে এই প্রতিবেদন লেখার সময়ও ভিডিওগুলো তাঁর ফেসবুক আইডির ওয়ালে ছিল।
প্রায় সাড়ে আট মিনিট দৈর্ঘ্যের এই চারটি ভিডিওতে রূপগঞ্জ উপজেলা যুবলীগের কার্যকরী সদস্য বাদশা মিয়া ও তাঁর ছেলে ছাত্রলীগ নেতা মো. হাসিবকে রামদা হাতে এবং ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ওমর ফারুককে রড হাতে মহড়া দিতে দেখা গেছে।
প্রায় সাড়ে আট মিনিট দৈর্ঘ্যের এই চারটি ভিডিওতে রূপগঞ্জ উপজেলা যুবলীগের কার্যকরী সদস্য বাদশা মিয়া ও তাঁর ছেলে ছাত্রলীগ নেতা মো. হাসিবকে রামদা হাতে এবং ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি ওমর ফারুককে রড হাতে মহড়া দিতে দেখা গেছে। ভিডিওগুলোতে ভুলতা চার নম্বর ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি এমদাদুল হক, সাধারণ সম্পাদক আফজাল মিয়া, সাংগঠনিক সম্পাদক তরিকুল ইসলামকে দেখা গেলেও তাঁদের হাতে কোনো অস্ত্র ছিল কি না আলোকস্বল্পতার কারণে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
বাদশা মিয়া ও ফরিদা ইয়াসমিনের দাবি, রামদাগুলো বিএনপি নেতা-কর্মীদের। ভুলতা ফাঁড়ির পুলিশ রামদাগুলো উদ্ধার করেছে। তবে পুলিশ রামদা উদ্ধারের বিষয়টি অস্বীকার করেছে।
ভিডিওগুলোতে অন্তত ১৫ জন তরুণ-যুবককে রামদা হাতে দেখা গেছে। তাদের মধ্যে চার নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুব মিয়া, এলাকায় যুবলীগ কর্মী হিসেবে পরিচিত মো. মোমেন, আবু হানি, মো. মাসুম, চার নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহজাহান মিয়ার ছেলে ছাত্রলীগ নেতা মো. রানা, এলাকায় ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে পরিচিত শাহাদাত মোল্লা, মো. সাব্বির ও মো. সাহিদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। ভিডিওতে থাকা অন্য অস্ত্রধারীদের পরিচয় জানা যায়নি।
মিছিলে থাকা একজন যুবলীগ নেতা এবং স্থানীয় কয়েকজন বিএনপি নেতা-কর্মীর সঙ্গে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। তাঁরা বলেন, সোমবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ভুলতা চার নম্বর ওয়ার্ড এলাকার পাড়াগাঁও, ঠাকুরবাড়ির টেক ও এবং লাবড়াপাড়া এলাকায় এসব মহড়া হয়। যুবলীগ নেতা বাদশা মিয়া, ওয়ার্ড যুবলীগ সাধারণ সম্পাদক মাহবুব মিয়া ও নারী ইউপি সদস্য ফরিদা ইয়াসমিন মহড়ায় নেতৃত্ব দেন। এ সময় তাঁরা ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানের পাশাপাশি বিএনপি ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দেন। মহড়ার একপর্যায়ে তারা পাড়াগাঁও গোরস্থান সড়কে চাদর, তোশক ও কিছু বাসনপত্র পুড়িয়ে দেন। এসব চাদর তোশক ও বাসনপত্র পুলিশের ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে কবরস্থানে আশ্রয় নেওয়া বিএনপি নেতা-কর্মীদের বলে দাবি করেছে বিএনপি।
ভিডিওগুলোতে দেখা যায়, একজন পুরুষ ফরিদা ইয়াসমিনের ফেসবুক আইডি থেকে মহড়া সরাসরি প্রচার করছেন। তিনি ভিডিওতে ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘বাদশা ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা সবাই বিএনপি দমন করার জন্য মাঠে নামছি।’
ভিডিওগুলোতে দেখা যায়, একজন পুরুষ ফরিদা ইয়াসমিনের ফেসবুক আইডি থেকে মহড়া সরাসরি প্রচার করছেন। তিনি ভিডিওতে ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘বাদশা ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা সবাই বিএনপি দমন করার জন্য মাঠে নামছি।’ এ সময় তিনি বাদশা মিয়া ও ফরিদা ইয়াসমিনের দিকে ক্যামেরা তাঁক করে তাঁদের কিছু বলতে বলেন। হাতে থাকা রামদা উঁচিয়ে বাদশা মিয়া বলেন, ‘জবাই করমু, জবাই।’ অন্য একটি ভিডিওতে অস্ত্রধারী সবাইকে রামদা ও রড উঁচিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দিতে দেখা যায়। আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, অস্ত্রধারীরা একটি ব্যস্ততম সড়কে অস্ত্র হাতে মহড়া দিচ্ছেন। এ সময় তারা ‘ধর ধর’ বলে দৌড়াদৌড়ি করছিলেন।
পাড়াগাঁও এলাকার ওই সড়কটিতে মহড়ার সময় ঘটনাস্থলে থাকা একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলাকায় এমন মহড়া প্রায় সময়ই দেখা যায়। অভ্যস্ততার কারণে ব্যক্তিগতভাবে আমি ভয় পাইনি। কিন্তু সড়কে থাকা লোকজন ও দোকানে আসা ক্রেতারা মহড়ার সময় আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।’
অস্ত্র হাতে এমন মহড়ার ঘটনা ঘটলেও সোমবার রাত থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত ওই এলাকার কোনো বিএনপি নেতা-কর্মীর বাড়িঘরে হামলার খবর পাওয়া যায়নি। স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের ভয় দেখাতে উপজেলাজুড়ে এমন মহড়া চলছে বলে দাবি করেন জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘গত ১৮ অক্টোবরের পর রূপগঞ্জের অন্তত ১৩ জন নেতা-কর্মীর বাড়িঘরে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি ঘটনার আগে হামলাকারীদের এমন অস্ত্রসহ মহড়া দিতে দেখা গেছে। তাঁরা মোস্তাফিজুর রহমানের নামে আপত্তিকর স্লোগান দেন, পরে বাড়িঘরে হামলা করেন।’ একদিকে মিথ্যা মামলায় পুলিশের ধরপাকড়, অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের হামলা ও মহড়ার কারণে বিএনপির লোকজন বাড়িতে থাকতে পারছে না বলে জানান তিনি।
রামদাসহ মহড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বাদশা মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপি জ্বালাও পোড়াও-এর জন্য পাড়াগাঁও গোরস্থানে একত্র হয়েছিল। খবর পেয়ে আমরা সেখানে গেলে তাঁরা পালিয়ে যায়। পরে আমরা সেখান থেকে তোশক, ১০০টি বাসন ও ৭-৮টি রামদা উদ্ধার করি। পরে ভুলতা ফাঁড়ির পুলিশ এসে রামদাগুলো নিয়ে যায়।’
তবে ভুলতা ফাঁড়ির ইনচার্জ মোস্তাফিজুর রহমান এমন দাবি অস্বীকার করেছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমরাও ফেসবুকে একটি ভিডিও দেখেছি। তারপর সেখানে পুলিশ পাঠানো হয়েছে। কিন্তু ঘটনাস্থলে কাউকে পাওয়া যায়নি। এমনকি কোনো দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। মিছিলকারীরা আইনের হাত থেকে বাঁচতে মিথ্যা বলে থাকতে পারেন।’
রূপগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) জুবায়ের হোসেনও ওই এলাকা থেকে দেশীয় অস্ত্র উদ্ধারের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, পুলিশ এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।