রোগ সারিয়ে মনও জুড়ায় যে হাসপাতাল

ফুলছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি উপজেলার তিন লক্ষাধিক মানুষের চিকিৎসার ভরসাস্থল। দীর্ঘদিন নানা অব্যবস্থাপনা ছিল। এখন আমূল পাল্টে গেছে সব।

বাইরে-অন্দরে এমনই সাজানো-গোছানো, পরিচ্ছন্ন গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি

বছর দুয়েক আগেও হাসপাতাল চত্বরের খোলা জায়গাটি অবহেলায় পড়ে ছিল। ময়লা–আবর্জনা ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকত। হাসপাতালের ভেতরটাও ছিল নোংরা। এখন চারদিক সবুজে ঘেরা। প্রধান ফটকে ঢুকতেই ফুলের বাগান। শোভা পাচ্ছে নানা জাতের ফুল। হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডের ভেতরে–বাইরে ঝকঝকে পরিবেশ। বারান্দার টবে নানা গাছ। ভেতরে ঢুকতেই জরুরি বিভাগ। পরিপাটি বিশ্রামাগার। দেয়ালে টানানো পরীক্ষা–নিরীক্ষার মূল্যতালিকা। হাসপাতালটিতে সেবা নিতে এসেও এলাকার মানুষ সন্তুষ্ট। এ দৃশ্য গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের।

হাসপাতালটির বদলে যাওয়ার নেপথ্যে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. রফিকুজ্জামান। পরিবেশগত উন্নয়ন ছাড়াও কমপ্লেক্সটি স্বাস্থ্যসেবায় অনন্য ভূমিকা রাখছে। সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও পরিবর্তন এসেছে সেবার ক্ষেত্রে।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি গাইবান্ধা শহর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরে। গত ১১ এপ্রিল সকালে প্রধান ফটক দিয়ে হাসপাতালে ঢুকতেই সবুজে ছাওয়া চত্বর চোখ জুড়িয়ে যায়। জরুরি বিভাগের সামনেই ফুলের বাগান। শোভা পাচ্ছে নানা জাতের ফুল। অপেক্ষমাণ কক্ষটি পরিপাটি। চিকিৎসা নিতে আসা অনেকে চিকিৎসকের সাক্ষাতের জন্য বসে আছেন। কেউ টিকিট কিনছেন। জরুরি বিভাগের পাশে নিজের কক্ষে বসে সিসিটিভি ক্যামেরার দৃশ্য মনিটরে পর্যবেক্ষণ করছিলেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. রফিকুজ্জামান।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দ্বিতীয় তলায় পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায় পরিচ্ছন্ন পরিবেশ। পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা জানালেন, দিনে কয়েকবার করে পরিষ্কার করেন তাঁরা।

মো. রফিকুজ্জামান

পুরুষ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন গাইবান্ধা সদর উপজেলার চুনিয়াকান্দি গ্রামের খলিল মিয়া বলেন, পেটব্যথা নিয়ে দুদিন আগে ভর্তি হয়েছেন। ভালো সেবা পাচ্ছেন। ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। খাবারের মানও ভালো। ডাকলে নার্সরাও আসেন। দুই বছর আগেও এই হাসপাতালে এসেছিলেন খলিল মিয়া। তখন এমন সেবা পাননি বলে জানালেন।

আগের চেয়ে হাসপাতালের পরিবেশ অনেক বদলে গেছে বলে জানালেন ফুলছড়ি উপজেলার চন্দিয়া গ্রামের খোকা মিয়া (৮০)। তিনি বলেন, ওয়ার্ডে এখন আর বিড়াল দেখা যায় না।

মহিলা ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন একই উপজেলার রামনাথের ভিটা গ্রামের গোলাপি বেগম (৪০) বলেন, শৌচাগার ও ওয়ার্ডের ভেতর নিয়মিত পরিষ্কার করা হচ্ছে। আগে এমনটা ছিল না।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আশপাশে আগে রাতে মাদকসেবীদের আড্ডা, দিনে বখাটেদের উৎপাত দেখা যেত। হাসপাতালের আঙিনা ছিল গরু-ছাগলের চারণভূমি। পরিবেশ থাকত নোংরা। রোগীর উপস্থিতি ছিল কম।

চিকিৎসা নিতে আসা অনেকে চিকিৎসকের সাক্ষাতের জন্য বসে আছেন পরিপাটি অপেক্ষমাণ কক্ষে

ফুলছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিয়ে কথা হয় গাইবান্ধার সিভিল সার্জন মো. আবদুল্লাহেল মাফীর সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গাইবান্ধা জেলায় সাতটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আছে। এর মধ্যে ফুলছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিত্র অনেকটা বদলে গেছে। আগে যেসব সমস্যা ছিল, তা এখন নেই। পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে রোগীর উপস্থিতি ও সেবার মান বেড়েছে। সেখানকার উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা রফিকুজ্জামানের প্রচেষ্টায় এটা সম্ভব হয়েছে।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে বর্তমানে ইসিজি, আলট্রাসনোগ্রাম, ডেন্টাল ইউনিট, স্বাভাবিক প্রসব, প্যাথলজি, ফার্মেসি, করোনা টেস্ট ও করোনার টিকা, গর্ভবতী মা ও শিশুর জন্য এএনসি কর্নার ও ইপিআই বা টিকাদান কর্মসূচি সেবা চালু রয়েছে। গত দুই বছরে শতাধিক নারীকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সন্তান প্রসব করানো হয়েছে। চালু রয়েছে ব্রেস্ট ফিডিং ব্যবস্থা ও পাঁচ বছরের নিচে শিশুদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য আইএমসিআই (ইন্টিগ্রেটেড ম্যানেজমেন্ট অব চাইল্ডহুড ইলনেস) সেবা। একটি বেসরকারি সংস্থার সহায়তায় ময়লা–আবর্জনা দহন চুল্লি ও নিরাপদ খাবার পানির ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে।

রফিকুজ্জামান ২০১৮ সালের শুরুতে ফুলছড়ি উপজেলায় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব নেন। তিনি যশোরের চৌগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মডেল দেখে অনুপ্রাণিত হন। ২০২১ সালের মার্চ থেকে ফুলছড়ি কমপ্লেক্সকে মডেল কমপ্লেক্স হিসেবে গড়তে কাজ শুরু করেন। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেন। এরপর মাত্র দুই বছরে কমপ্লেক্সের চিত্র অনেকখানি পাল্টে দিয়েছেন।

২০০৮ সালে ফুলছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ৩৩ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। প্রতিদিন সেখানে ৩০ থেকে ৩৫ জন ভর্তি থাকেন

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে অস্ত্রোপচারকক্ষ আছে। আগে অস্ত্রোপচার হতো না। গত মার্চ থেকে অর্থোপেডিকসের ছোটখাটো অস্ত্রোপচার শুরু হয়েছে। শিগগির প্রসূতি অস্ত্রোপচারও শুরু হবে। ডেন্টাল চিকিৎসক ছিলেন। আগে ডেন্টাল ইউনিটের চিকিৎসাসামগ্রী ছিল না। বর্তমানে উপজেলা পরিষদের সহযোগিতায় ডেন্টাল ইউনিটের চিকিৎসাসামগ্রী দিয়ে নিয়মিত মুখ ও দাঁতের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সরকারিভাবে মাত্র একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী থাকলেও স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় আরও তিনজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

হাসপাতালটির সেবার মান নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জি এম সেলিম পারভেজ প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি উপজেলার তিন লক্ষাধিক মানুষের চিকিৎসার একমাত্র ভরসাস্থল। এখানে দীর্ঘদিন নানা অব্যবস্থাপনা ছিল। রফিকুজ্জামানের প্রচেষ্টায় এখানে অনেক পরিবর্তন এসেছে। তাঁকে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

আগের ও বর্তমানের চিকিৎসসেবার তুলনা করতে গিয়ে ফুলছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) রাকিবুল হাসান বলেন, দুই বছর আগে প্রতিদিন বহির্বিভাগে ৫০ থেকে ৬০ জন চিকিৎসা নিতেন। আর অন্তর্বিভাগে ৫ থেকে ৬ জন ভর্তি থাকতেন। এখন রোজ বহির্বিভাগে ৩০০ থেকে ৩৫০ জন চিকিৎসা নিতে আসেন। আর অন্তর্বিভাগে ৩০ থেকে ৩৫ জন ভর্তি থাকেন।

ফুলছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বহির্বিভাগে ৩০০ থেকে ৩৫০ জন চিকিৎসা নিতে আসেন

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, ২০০৮ সালে কমপ্লেক্সটি ৩৩ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। কমপ্লেক্সটি দুটি ব্লকে বিভক্ত। এখানে চিকিৎসক, নার্সসহ জনবল দরকার ১৩৮ জন। এর মধ্যে বর্তমানে রয়েছেন ৯৩ জন। বাকি ৪৫টি পদ শূন্য। চিকিৎসকের ২২টি পদের মধ্যে ১২টি পদই শূন্য। চিকিৎসকের শূন্য পদের মধ্যে ৯ জন জুনিয়র কনসালট্যান্ট, একজন আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা এবং একজন চিকিৎসা কর্মকর্তা (ইউনানি)। বর্তমানে ১০ জন চিকিৎসক দিয়ে সেবা দেওয়া হচ্ছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. রফিকুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক নেই। যা আছে, তাই দিয়েই আন্তরিকতার সঙ্গে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছি। জরুরি বিভাগে সার্বক্ষণিক ২৪ ঘণ্টা সেবা দেওয়া হচ্ছে। আমাদের লক্ষ্য এ কমপ্লেক্সকে একটি মডেল স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করা, যাতে চরাঞ্চলসহ এলাকার মানুষ হাতের কাছেই স্বাস্থ্যসেবা পান।’