সুন্দরবনে গত দুই দশকে আগুন লাগার ঘটনায় করা ২৪টি তদন্ত প্রতিবেদনের বেশির ভাগগুলোতে বলা হয়েছে, বনজীবীদের ফেলে আসা আগুন থেকে আগুনের সূত্রপাত। এসব তদন্ত প্রতিবেদনে বনজীবীদের ফেলে দেওয়া আগুন থেকে সুন্দরবনে আগুনের সূত্রপাত—এমন সম্ভাবনার কথা ১৫ বার উল্লেখ করা হয়েছে। জেলে ও মৌয়ালদের বিড়ি-সিগারেট বা মৌমাছি তাড়াতে জ্বালানো মশাল থেকে আগুনের সূত্রপাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক ও ‘সুন্দরবন রক্ষায় আমরা’র সমন্বয়কারী মো. নূর আলম শেখ বলেন, তদন্ত কমিটি শুধু বন বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে করা হয়। ফলে এক পেশে হওয়ার ঝুঁকি থাকে। সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ডের মূল রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয় না। তাঁরা বনজীবীদের দিকে যে ইঙ্গিত করেন, এটা সবসময় সঠিক না। আগুন লাগার ঘটনার সঙ্গে বন বিভাগের লোকজন, বিশেষ করে টহল ফাঁড়ি বা স্টেশন পর্যায়ের কর্মকর্তারা অনেক সময় যুক্ত থাকেন। অসৎ কিছু মাছ ব্যবসায়ীর সঙ্গে তাদের আঁতাত থাকে।
সুন্দরবনে গত দুই দশকে ২৫ বার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। বন বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনে গত দুই দশকে যেসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, এর সব কটি ঘটনাই ঘটেছে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগে সুন্দরবনের ভোলা ও মরা ভোলা নদীসংলগ্ন এলাকায়।
আগুন লাগার ঘটনাগুলো কেন বারবার শুধু সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগে ঘটছে—এ ব্যাপারে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক মো. ওয়াসিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আগুন লাগার ঘটনাগুলো মোটামুটি একই জায়গায় ঘটেছে। চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জের কিছু এলাকায়। এর কারণ হচ্ছে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগে একসময় নদী খননের নামে খননের মাটিগুলোকে এমনভাবে বনের দুই পাশে রাখা হয়েছে, সেটা একটা বাঁধের মতো হয়ে গেছে। অপরিকল্পিত এই খননে বনের ভেতর জোয়ার–ভাটা হতে পারছে না। সেখানকার ভূমিটা একবারে শুষ্ক থাকে। বর্ষা মৌসুমের আগে আগে এটা আরও শুষ্ক হয়ে যায়। সে জন্য এখানে আগুন সহজভাবে ধরতে পারে।
সুন্দরবনের নদী–খালে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে না আনলে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড থেকে সুন্দরবনকে রক্ষা করা কঠিন হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে অগ্নিকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে বনের মধ্যে চোরা শিকারিসহ মানুষের অবাধ যাতায়াত বন্ধের দাবি আবারও তুলেছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো।
পানির প্রবাহ না থাকায় ভবিষ্যৎ অগ্নিকাণ্ডের মতো ঘটনায় বনকে রক্ষা করা কঠিন হবে জানিয়ে গবেষক অধ্যাপক ওয়াসিউল ইসলাম বলেন, বনের মধ্যে পানির প্রবাহ না থাকা বড় একটা ইস্যু হয়ে গেছে। এ জন্য বড় ধরনের একটা প্রকল্প দরকার। বাংলাদেশ বন বিভাগের সঙ্গে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের বিভিন্ন শাখা, নদীশাসনের কাজ যাঁরা করেন, তাঁদের সবার একটা সমন্বয় দরকার। একটা পরিকল্পিত পদ্ধতিতে প্রকল্পটা নেওয়া দরকার। কারণ, আগের মতো প্রকল্প নিয়ে যদি মাটি বনের মধ্যে ফেলা হয় এবং বনকে যদি উঁচু করে দেওয়া হয়; তবে ম্যানগ্রোভের জন্য যে পরিবেশ লাগে, সেটা নষ্ট হবে। তখন নতুন প্রকল্পেও কোনো লাভ হবে না।
এদিকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রতিবারই বন বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে তদন্ত কমিটি করা হয়। গত শনিবারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাতেও বন কর্মকর্তাদের তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। তদন্ত কমিটি শুধু বন বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে না গঠন করে সেখানে পরিবেশবিদ, স্থানীয় বনজীবী, সুন্দরবন গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করারও দাবি উঠেছে। গতকাল রোববার আমুরবুনিয়া এলাকায় মানববন্ধন করে এই দাবি তোলে কয়েকটি পরিবেশবাদী সংগঠন।
বাপা ও ‘সুন্দরবন রক্ষায় আমরা’র নেতা মো. নূর আলম শেখের দাবি, পরিবেশকর্মী, সংবাদকর্মী, গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা এবং অতীতে সংগঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন না করার কারণেই সুন্দরবনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
এদিকের সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগে আগুন লাগার ঘটনা গত দুই দশকে নেই। কেন, সেটা জানতে চাওয়া হয়েছিল পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আবু নাসের মোহসিন হোসেনের কাছে। তিনি বলেন, ওখানকার ভোলা, মরা ভোলা নদী পলিতে ভরাট হয়ে গেছে। সেখানে জোয়ার-ভাটা হয় না। সেটা বড় কারণ। সেখানে সেপ্টেম্বর মাস থেকে বনে পানি ঢোকা বন্ধ হয়ে যায় আর এপ্রিল-মে মাসের তাপপ্রবাহের কারণে ওই জায়গাগুলো আরও শুষ্ক হয়ে থাকে। এখন পরিকল্পিতভাবে নদী খনন করাটা সবচেয়ে জরুরি। আবার নদী মরে যাওয়ায় ওই সব গ্রামের মহিষ সুন্দরবনের মধ্যে চলে যায়। রাখালেরা ধূমপান করেন। এসব অসাবধানতার কারণে আগুন ধরে।