শুকনা জমিতে সবজির চারা মাথা তুলেছে। ছড়ানো পাতার ফাঁকে ফাঁকে ছোট ফুলকপি উঁকি দিচ্ছে। শুকিয়ে আসা জমিতে সবজির চারাগুলো বাঁচিয়ে রাখার জন্য দূরের পুকুর থেকে গ্যালন ভর্তি করে পানি আনছিলেন কৃষিশ্রমিক মো. মনসুর (২৮)। জমিতে পানি দিতে দিতে সেচের কষ্টের কথা বলতে থাকেন তিনি। সন্দ্বীপের আঞ্চলিক ভাষায় বললেন, ‘সেচের ব্যবস্থা নাই। তিন শ গজ দূরের হইরের (পুকুর) তুন কান্ধে করি গ্যালান ভরি পানি আনতে হইতেছে।’
চট্টগ্রামের দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপের বাউরিয়া ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের একটি জমিতে কাজ করছিলেন মনসুর। ওই এলাকার সব কৃষকেরই একই অবস্থা। সেচের ব্যবস্থা না থাকায় পুকুর থেকে পানি এনে জমিতে ছিটিয়ে ফসল বাঁচানোর চেষ্টা করছেন কৃষকেরা। সারা দ্বীপেই সেচের পানির জন্য এমন হাহাকার।
কৃষকেরা জানান, সন্দ্বীপে সেচ বিভাগের কর্তাদের পা পড়েনি কোনোকালে। ব্যক্তিমালিকানার পুকুর ও খালের পানির ওপর চাষাবাদ নির্ভরশীল বলেই শুষ্ক মৌসুমে এমন দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে তাঁদের। সাধারণত শাকসবজির চাষ হয় যে চরাঞ্চলে, সেখানে এখন পুকুর নেই বললেই চলে। ফলে বর্ষার শেষ দিকে খালে বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রেখে তা সবজিখেতে সেচের কাজে ব্যবহার করা হয়। খালের জমানো পানি শুকিয়ে গেলেই প্রকট হয়ে ওঠে পানির সংকট।
গত মঙ্গলবার দ্বীপের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, মাঠে মাঠে সেচের পানির জন্য কৃষকেরা হাহাকার করছেন। একসময়ের বিস্তীর্ণ ফসলি জমি এখন সেচের পানির অভাবে অনাবাদি থাকছে। অল্পসংখ্যক চাষি এখনো মাঠে শীতের শাকসবজি চাষ করলেও পানির অভাবে নাভিশ্বাস উঠেছে তাঁদের। বাউরিয়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের চাষি মাইনুদ্দিন জানিয়েছেন, সেচের পানির তীব্র সংকটের কারণে দিন দিন শাকসবজির চাষ কমিয়ে আনতে বাধ্য হচ্ছেন তিনি।
বাউরিয়া ইউনিয়নে গিয়ে দেখা গেছে, ২০ শতক জমির মাচাজুড়ে ছেয়ে আছে রুগ্ণ করলালতা। বেশির ভাগ পাতাই হলুদ আর শুকিয়ে আসা। ওই জমির মালিক কৃষক মো. মাইনুদ্দিন জানিয়েছেন, পানির অভাবে তাঁর করলাগাছের এমন দুরবস্থা। সেচের পানির জোগান থাকলে প্রচুর ফলন পেতেন। আগে যতটুকু জমিতে চাষ করতেন, তার চেয়ে চাষাবাদ অনেক কমিয়েছেন বলে জানান তিনি। একই দশা তাঁর টমেটো, কপি আর মরিচখেতেরও। কোথাও পানি নেই। না খালে, না কাছের কোনো পুকুরে। শীতকালীন সবজিচাষিদের এমন নাকাল হওয়ার দিনে নির্বিকার রয়েছে সরকারের ক্ষুদ্র সেচ বিভাগ। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে কখনো সেচ বিভাগের কোনো প্রকল্পের কাজ হয়নি বলে জানা গেছে।
বিভিন্ন এলাকার সবজিচাষি, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এবং সেচ বিভাগের চট্টগ্রাম অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী—কেউই সন্দ্বীপে সরকারিভাবে সেচকাঠামো নির্মাণের কোনো তথ্য দিতে পারেননি। ব্রিটিশ শাসনামলে সন্দ্বীপের চরাঞ্চলে গবাদিপশু পালন এবং চাষের সুবিধা দিতে পুকুর খনন করা হলেও সেগুলো আর ব্যবহারের উপযোগী নেই।
সন্দ্বীপ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মারূফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘সেচ বিভাগের কাছে আমি দাবি জানিয়েছি গভীর নলকূপ দিয়ে ভূগর্ভস্থ পানির মাধ্যমে সেচের ব্যবস্থা করতে। সেচসুবিধা নিশ্চিত করতে না পারলে সন্দ্বীপের কৃষকেরা বাঁচবে না।’
কৃষকদের দাবি সেচের জন্য পুকুর খনন করা। বিএডিসির চট্টগ্রাম অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলামের কাছে পুকুর খনন নিয়ে জানতে চাইলে তিনি সুস্পষ্ট কোনো অগ্রগতির কথা জানাতে পারেননি। তবে এ নিয়ে সন্দ্বীপে ক্ষুদ্র সেচ বিভাগ কাজ করবে বলে নিশ্চিত করেছেন।
তীব্র পানির সংকটে নাকাল সবজিচাষিদের দাবি, সেচের পানি পেলে তাঁরা শীতকালীন শাকসবজির চাষাবাদ বহুগুণে বাড়াতে পারবেন। পানি না পেলে চাষাবাদে টিকে থাকা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হবে না।