চুয়াডাঙ্গায় অনেক শিশু ওয়ার্কশপ, ভাঙারির দোকানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়ায় শিশুশ্রম বন্ধ হচ্ছে না।
চুয়াডাঙ্গা শহর, শহরতলীসহ বিভিন্ন এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুশ্রমিক নিয়োগ চলছেই। শিশুশ্রম বন্ধে আইন থাকলেও তা প্রয়োগে তেমন নজির নেই। নেই দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ। ফলে, মোটরগাড়ি ও মোটরসাইকেলের ওয়ার্কশপ, ওয়েল্ডিংয়ের দোকান, বহুতল ভবন নির্মাণ ,ভাঙারির দোকান, স্টিল ও কাঠের আসবাবের দোকান এবং হোটেল-রেস্তোরাঁয় শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
আজ ১২ জুন ‘শিশুর শিক্ষা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করি, শিশুশ্রম বন্ধ করি’ শ্লোগানে পালিত হচ্ছে বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। শিশুশ্রম প্রতিরোধ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সারা বিশ্বে দিবসটি পালিত হয়। কিন্তু শিশুশ্রম বন্ধে কার্যকর ভূমিকা নেওয়া হচ্ছে না।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) নাজমুল হামিদ রেজা বলেন , শিশুশ্রম বন্ধে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে সতর্ক থাকতে হবে। তা ছাড়া সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে। সবাই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে তা একদিন বন্ধ হয়ে যাবে।
২০১৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) আইন ২০১৮–এর খসড়া নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। সে অনুযায়ী কেউ যদি শিশুশ্রমিক নিয়োগ করে, তাঁকে পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড করা হবে। আইন অনুযায়ী ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত কিশোরেরা হালকা কাজ করতে পারবে। আগে ১২ বছরের শিশুদের এমন হালকা কাজের সুযোগ ছিল।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে নিকট অতীতে এই আইনের কোনো প্রয়োগ চুয়াডাঙ্গাতে দেখা যায়নি। চুয়াডাঙ্গা জেলায় কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের কোনো কার্যালয় নেই। প্রতি তিনমাস পর পর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এ–সংক্রান্ত কমিটির একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে কুষ্টিয়া থেকে একজন পরিদর্শক সভায় যোগ দেন। তবে শিশুশ্রম বন্ধ বা আইন প্রয়োগে তাঁদের কোনো ভূমিকা চোখে পড়ে না।
প্রতিষ্ঠানটির কুষ্টিয়া কার্যালয়ের কর্মকর্তাদেরকে চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর জেলায় অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতে হয়। অধিদপ্তরের কুষ্টিয়া কার্যালয়ের উপমহাপরিদর্শক (চলতি দায়িত্ব) সানজাত বিল্লাহ সরাসরি স্বীকার করে বলেন, কুষ্টিয়া জেলা দায়িত্ব পালনে হিমশিম অবস্থা। সে কারণে চুয়াডাঙ্গাতে সেভাবে তদারকি করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বিষয়টি নিয়ে তিনি পরিদর্শক রাজু বড়ুয়ার সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পরিদর্শক রাজু বড়ুয়া জানান, মাঝেমধ্যে চুয়াডাঙ্গাতে যাওয়া পড়ে। তিনি দাবি করেন, চুয়াডাঙ্গা জেলায় তাঁদের নজরদারিতে ১০০ ছোট-বড় কলকারখানা আছে। এসব কারখানায় শিশুশ্রম চোখে পড়েনি। মোটরগাড়ির গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপসহ এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুশ্রমিক নিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ জন্য শিশুর অভিভাবক ৮০ শতাংশ ও নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ ২০ শতাংশ দায়ী। যতই অভাব-অভিযোগ থাকুক, কোনো সচেতন অভিভাবক কখনোই চাইবেন না তাঁর সন্তান শ্রম বিক্রি করুক।’
এক প্রশ্নের জবাবে রাজু বড়ুয়া বলেন, আইনের প্রয়োগ বা শাস্তি বড় কথা না। শিশুকে যাতে কেউ শ্রম বিক্রি করতে না পাঠান বা কেউ তাঁর প্রতিষ্ঠানে না নেন, সে বিষয়ে প্রচার-প্রচারণা করতে হবে। সব কথার শেষ কথা বিদ্যালয় থেকে শিশুদের ঝরে পড়া ঠেকাতে পারলেই শিশুশ্রম দিন দিন বন্ধ হয়ে যাবে। এ জন্য ঝরে পড়ার কারণ চিহ্নিতকরণসহ তা সমাধানে উদ্যোগ নিতে হবে। অভিভাবকের মধ্যে যদি সন্তানদের স্কুলে পড়ানোর উৎসাহ না থাকে, তাহলে শিশুশ্রম বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক।’
শিশুশ্রমের বিষয়ে কথা হয় সহকারী জেলা প্রাথমিক কর্মকর্তা শারমিন সেলিনা আজহারের সঙ্গে। তিনি বলেন, অভিভাবকের অস্বচ্ছলতা ও কর্মহীনতার কারণে পরিবারের বড় সন্তানটি শিশু বয়সেই শ্রমিক-কর্মচারী হিসেবে কাজে নিযুক্ত হচ্ছে। আসলে পেটে ক্ষুধা রেখে তো পড়াশোনা হয় না। খণ্ডকালীন শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে করতে অনেকেরই পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ।
মুরছালিন, তৌফিক, তানভীর, চয়ন ও অনিক। কারও বয়স ১২ বছর, তো কারও বয়স ১৩ কিংবা ১৪ বছর। তারা সবাই মোটরগাড়ির ওয়ার্কশপের শিশুশ্রমিক। গতকাল চুয়াডাঙ্গার শহরতলী দৌলাতদিয়াড় এলাকার বিভিন্ন ওয়ার্কশপে তাদের মতো অনেক শিশুকে কাজ করতে দেখা যায়।