সৌদি আরবে যাওয়ার ফ্লাইট ধরতে ট্রেনে করে রওনা দিয়েছিলেন কিশোরগঞ্জের রাসেল। বাজিতপুরের গ্রামের বাড়ি থেকে নরসিংদীতে পরিবারের কাছে যেতে ট্রেনে উঠেছিলেন আসির। মা–বাবার সঙ্গে ছুটি কাটিয়ে স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে ঢাকায় ফিরছিলেন হীরা বেগম। সবুজ শীল ভৈরব থেকে নরসিংদীতে মেয়ের বাড়িতে যাচ্ছিলেন।
তাঁদের মতো ১৮ জনের জীবন থেমে গেছে ভৈরব রেলস্টেশনের আউটার পয়েন্টে। গতকাল সোমবার সেখানে এগারসিন্দুর ট্রেনে মালবাহী ট্রেনের ধাক্কায় তাঁদের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় শতাধিক আহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের স্বজন ও আহত ব্যক্তিদের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠে ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবেশ। দুর্ঘটনার পর গতকাল হাসপাতালটিতে যান প্রথম আলোর প্রতিবেদকেরা। সেখানে নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা দিয়েছেন দুর্ঘটনার বর্ণনা, জানিয়েছেন তাঁদের হারিয়ে ফেলা স্বজনদের গল্প।
দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৭০ জনকে ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনা হয়। এর মধ্যে ২১ জনকে ঢাকাসহ বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়। অন্যান্য হাসপাতালে নেওয়া হয় আরও অন্তত ৩০ জনকে। রাতেই স্বজনদের কাছে লাশগুলো হস্তান্তর করা হয়।
পরিবারের হাল ধরতে সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য এগারসিন্দুর ট্রেনে করে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন রাসেল মিয়া। সঙ্গে ছিলেন মা, ছোট ভাই, ভাগনি ও দুলাভাই। গতকাল বিকেলের ট্রেন দুর্ঘটনায় পরিবারের সবাই বেঁচে গেলেও রাসেল চলে যান না–ফেরার দেশে।
রাসেল কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের হাবিব মিয়ার ছেলে। গতকাল বিকেলে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে রেলস্টেশনের আউটার পয়েন্টে ক্রসিংয়ে যাত্রীবাহী ট্রেনের দুর্ঘটনায় নিহত ১৮ জনের মধ্যে তিনি একজন। এগারসিন্দুর ট্রেনের বগি থেকে তাঁর রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করেন স্বজনেরা।
ছেলের মৃত্যুর পর গতকাল রাতে রাসেলের মা রোকেয়া বেগম ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বাইরে মেঝেতে অজ্ঞান অবস্থায় শুয়ে ছিলেন। তাঁর পাশে ছিলেন রাসেলের ভাই হামিম ও ভাগনি ইভা।
নিহত রাসেলের ভাই মো. হামিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য আমার ভাইয়ের সবকিছু ঠিকঠাক ছিল। বুধবার তাঁর ফ্লাইট ছিল। এ জন্য বেলা একটার দিকে ভাইয়ের সঙ্গে আমি, আমার মা, ভাগনি, দুলাভাই কিশোরগঞ্জ থেকে এগারসিন্ধুর ট্রেনে উঠি। যে বগিটি দুমড়েমুচড়ে গেছে, ওই বগিতে আমরা ছিলাম। মা, ভাগনি, দুলাভাইসহ আমি ট্রেনের ভেতর থেকে অক্ষত বের হয়েছি। কিন্তু আমার ভাইকে আর অক্ষত পেলাম না। তাঁর রক্তাক্ত লাশ আমরাই উদ্ধার করেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘ট্রেনের ভেতরে প্রচুর যাত্রী ছিলেন। দুর্ঘটনার পর বগির ভেতর থেকে কেউ বের হতে পারছিলেন না। ট্রেনের ভেতর একটি লাশকে দুই ভাগ হয়ে যেতে দেখেছি আমি।’
কৃষিকাজসহ দিনমজুরের কাজ করেন আসির উদ্দিন। তাঁর সামান্য আয়ে চলত স্ত্রী, তিন ছেলে, এক মেয়েসহ ছয়জনের পরিবার। গ্রামের বাড়ি থেকে নরসিংদীতে পরিবারের কাছে যাওয়ার উদ্দেশে রওনা দেন আসির। কিন্তু ট্রেন দুর্ঘটনায় আর পরিবারের কাছে ফেরা হলো না তাঁর।
আসির কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার দইগাঁও গ্রামের বাসিন্দা। পরিবার নিয়ে তিনি নরসিংদী জেলা শহরের একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। পেশায় তিনি কৃষিকাজ করেন। পরিবারের ভরণপোষণ করতে তিনি দিনমজুরের কাজও করেন।
ট্রেন দুর্ঘটনার খবর পেয়ে বাজিতপুর ও নরসিংদী থেকে কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে হাজির হন আসির উদ্দিনের মা সোরিয়া বেগম, বোন সাবিনা বেগম, ভাই শফিকুল ইসলাম। তাঁরা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বাইরে গাড়ি রাখার গ্যারেজের ভেতর অন্ধকারে বসে আহাজারি করছিলেন।
নিহত ব্যক্তির স্বজনেরা বলেন, কটিয়াদির মানিকখালী রেলস্টেশন থেকে বেলা ১১টার দিকে এগারসিন্ধুর ট্রেনে ওঠেন আসির উদ্দিন। নরসিংদীতে পরিবারের কাছে যেতে ট্রেনে উঠেছিলেন তিনি। কিন্তু দুর্ঘটনায় তিনি চিরদিনের জন্য বিদায় নিলেন। পরিবারের কাছে তাঁর আর ফেরা হলো না।
মা–বাবার সঙ্গে ছুটি কাটিয়ে এগারসিন্ধুর এক্সপ্রেস ট্রেনে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেন হীরা বেগম (২৬)। ট্রেনে তাঁর সঙ্গে স্বামী ও দুই বছরের ছেলেসন্তান ছিল। ভৈরবে রেলস্টেশনের আউটার পয়েন্টে ক্রসিংয়ে মালবাহী ট্রেনের সঙ্গে যাত্রীবাহী ট্রেনের ধাক্কায় প্রাণ হারান হীরা। তবে এ দুর্ঘটনায় হীরার স্বামী-সন্তান বেঁচে গেছেন।
হীরা বেগমের স্বজনেরা জানান, শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে তিন দিন আগে কর্মস্থল থেকে ছুটি নিয়ে ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জে মা–বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন হীরা বেগম। ছুটি কাটিয়ে সোমবার বেলা পৌনে একটার দিকে কিশোরগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে স্বামী-সন্তানসহ ট্রেনে উঠেছিলেন তিনি। ঢাকায় ফেরার পথে ভৈরবে মর্মান্তিক ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান এই নারী। হীরা ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন।
গতকাল সন্ধ্যায় ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে হীরা বেগমের লাশ নিতে এসেছিলেন তাঁর চাচা আবু তালেব। তিনি বলেন, এগারসিন্দুর এক্সপ্রেস ট্রেনটিতে হীরার সঙ্গে তাঁর স্বামী ও দুই বছরের ছেলে থাকলেও তাঁরা প্রাণে বেঁচে গেছেন। রেলওয়ের অবহেলার কারণেই এমন একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতগুলো প্রাণ ঝরে গেছে।
রোববার নরসিংদীতে একমাত্র মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে যান সবুজ শীল (৫০)। গতকাল সোমবার দুপুরে কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে আসেন তিনি। কাজ শেষে আবার মেয়ের বাড়িতে ফিরতে এগারসিন্ধুর ট্রেনে ওঠেন তিনি। কিন্তু দুর্ঘটনা তাঁকে আর গন্তব্যে পৌঁছাতে দেয়নি। ওই ট্রেনের দুমড়েমুচড়ে যাওয়া বগিতে ছিলেন সবুজ শীল।
সবুজ শীল ভৈরবের রানীর বাজারে স্ত্রী শান্তি রানী শীলকে নিয়ে একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। রানীর বাজারে তিনি একটি দোকানে চুল কাটতেন। একমাত্র মেয়ে শম্পা রানী শীলকে নরসিংদী বিয়ে দিয়েছিলেন।
নিহত স্বজন হৃদয় শীল বলেন, মেয়ের বাড়ি থেকে মূলত কিস্তির টাকা পরিশোধ করার জন্যই সবুজ শীল ভৈরবে এসেছিলেন। কাজ শেষে দুপুরে ভৈরব রেলস্টেশন থেকে এগারসিন্ধুর ট্রেনে উঠে আবার মেয়ের বাড়ি নরসিংদীর উদ্দেশে রওনা হন তিনি। নরসিংদী ফিরে সন্ধ্যায় মেয়ে শম্পা রানীর সঙ্গে তাঁর পূজা দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পূজায় আর তাঁর যাওয়া হলো না।
গতকাল রাত নয়টার দিকে নিহত ব্যক্তি স্ত্রী শান্তি রানী ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভেতরে স্বামীর জন্য আহাজারি করছিলেন। একটু পরপরই তিনি মূর্ছা যাচ্ছিলেন। এ সময় স্বজনেরা কোনোমতে তাঁকে সামলানোর চেষ্টা করছিলেন।