খুলনায় প্রাথমিক শিক্ষা 

ঝরে পড়া রোধে স্কুলটি সেরা 

কয়রার হড্ডা ডিএম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০১৫ সাল থেকে একজন শিক্ষার্থীও ঝরে পড়েনি।

বাড়িতে অনেক শিক্ষার্থীর খেলনা নেই। বিদ্যালয়ে খেলনা নিয়ে খেলতে খেলতে পড়ালেখা করে অনেকে। ১৮ অক্টোবর তোলা
 ছবি: প্রথম আলো

নিরুপমের (১০) বাবা অমর বিশ্বাস হঠাৎ অসুস্থ হয়ে কর্মহীন হয়ে পড়েন। তার মা পারুল বিশ্বাস বিভিন্ন বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ শুরু করেন। শিশু নিরুপম গ্রামের একটি তরমুজখেতে কাজ নেয়। বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায় তার।

বিষয়টি জানতে পেরে নিরুপমের সঙ্গে দেখা করেন হড্ডা ডিএম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অরুণ কুমার সানা। পরে স্থানীয় ইউপি সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে প্রধান শিক্ষক হাজির হন নিরুপমের বাড়িতে। তাঁরা নিরুপমের বাবার সঙ্গে কথা বলেন। স্থানীয় ইউপি সদস্যের নিয়মিত আর্থিক সহযোগিতার আশ্বাস পেয়ে ছেলেকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে রাজি হন তিনি। পরদিন থেকে পুনরায় বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করে নিরুপম। এখন সে হড্ডা ডিএম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির নিয়মিত ছাত্র।

বিদ্যালয়টির অবস্থান খুলনার কয়রা উপজেলার মহেশ্বরীপুরের হড্ডা গ্রামে। নিরুপমের মতো ঝরে পড়া অনেক শিক্ষার্থী পুনরায় বিদ্যালয়ে ফিরে এসেছে। এই সাফল্যের স্বীকৃতিও পেয়েছে বিদ্যালয়টি। প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখার জন্য জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা পদক ২০২২ প্রতিযোগিতায় খুলনা জেলায় শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার কমাতে সেরা বিদ্যালয় হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে হড্ডা ডিএম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে বিভিন্ন উদ্যোগের কথা জানান বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অরুণ কুমার সানা। তিনি বলেন, পরস্পরের কাছাকাছি বাড়ি, এমন কয়েকজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে ‘বন্ধু-সাথি’ নামের একটি করে দল করা হয়েছে। ওই বন্ধু-সাথি দলের কেউ একজন স্কুলে অনুপস্থিত থাকলে শিক্ষকদের জানায় অন্য সাথিরা। এভাবে শিক্ষার্থীদের নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন শিক্ষকেরা।

অরুণ কুমার সানা বলেন, তাঁরা পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা করে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার একেবারেই শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। ২০১৫ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীও ঝরে পড়েনি।

বর্তমানে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০৬। শিক্ষক রয়েছেন পাঁচজন। সম্প্রতি ওই বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, শ্রেণিকক্ষের দৃশ্য মনোমুগ্ধকর। দেয়ালে আঁকা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও কবি-সাহিত্যিকদের প্রতিকৃতি। এ ছাড়া রয়েছে বাঘ, ভালুক, ময়ূর, হরিণ, খরগোশ, হাতি, বক, কুমিরসহ বিভিন্ন প্রাণির ছবি। শিশুদের শিক্ষা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন খেলনা।

বিদ্যালয়টিতে রয়েছে সুশাসন ও শুদ্ধাচারে সততা স্টোর, মুক্তিযুদ্ধ কর্নার ও মানবতার দেয়াল। প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে পাঠদান করা হয়। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে অভিভাবকদের সহযোগিতায় শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয় দুপুরের খাবার।

বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী মিনা নানাবাড়িতে থেকে এই বিদ্যালয়ে পড়ে। তার নানি সুষমা রানী বলেন, পরিবারের অভাবের কারণে মিনাকে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে পাঠিয়েছিলেন। কিছুদিন পর স্কুলের স্যাররা এসে মিনাকে স্কুলে নিয়ে গেছেন। তাঁকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করছেন। মেয়েটা পড়াশোনায় ভালো।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান বললেন, ‘হড্ডা ডিএম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধে একটি আদর্শ মডেল। বিদ্যালয়টি যেসব ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। আশা করি, বিদ্যালয়টি জাতীয় পর্যায়ে নাম করবে।’