পাইকগাছার কুমখালী গ্রামের একটি অংশের বাঁধ ইতিমধ্যে ভেঙে গেছে। রিংবাঁধ দিয়ে কোনোরকম ওই অংশের ভাঙন ঠেকানো হয়েছে।
‘যখন জোয়ারের পানি বাড়ে তখন বুকের মধ্যে ধকধক করে, কখন যে বাঁধ ভেঙে যায়, সেই আতঙ্কে থাকি। মাঝে মাঝে অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় জোয়ারের পানি আরও বেড়ে যায়, তখন আতঙ্ক আরও বাড়ে।’ কথাগুলো বলছিলেন মো. রবিউল ইসলাম গাজী।
খুলনার পাইকগাছা উপজেলার গড়াইখালী ইউনিয়নের কুমখালী গ্রামে বাড়ি তাঁর। তাঁর বাড়ির গা ঘেঁষে চলে গেছে প্রমত্ত শিবসা নদীর বাঁধ। সেই বাঁধের বিভিন্ন জায়গায় ভয়াবহ ভাঙন শুরু হয়েছে। এতে রবিউল ইসলামের মতে আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটছে পাইকগাছা গড়াইখালী, চাঁদাখালী ও কয়রা উপজেলার আমাদী ইউনিয়নের অন্তত ২০টি গ্রামের কয়েক হাজার মানুষ।
রবিউল ইসলাম বলেন, ‘গত ৩০ সেপ্টেম্বর ও ১ অক্টোবর জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেড়ে যায়। তখন দিনভর আতঙ্কে কেটেছে, রাতে ঘুম হয়নি। বাড়ির মালামাল গুছিয়ে রেখে বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করতে সারা রাত লোকজন নিয়ে রাস্তার ওপর কাটিয়েছি। যেকোনো সময় বাঁধ ভেঙে যাবে, এমন শঙ্কায় ছিলাম।’
মূলত উত্তর-দক্ষিণ দিকে বয়ে যাওয়া শিবসা নদীর সঙ্গে পূর্ব দিক থেকে চলে আসা ঢাকী নদী মিলেছে ওই স্থানে। ঢাকী নদীর ভাটার টানের স্রোত সরাসরি ওই স্থানে এসে ধাক্কা খায়। এ কারণে ভাঙনপ্রবণতা বেশি। শিবসা পাইকগাছা উপজেলার মধ্য দিয়ে গড়াইখালী হয়ে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। গড়াইখালীর ওই স্থানে নদীর প্রস্থ দুই কিলোমিটারেরও বেশি, গভীরতাও অনেক।
গড়াইখালী ইউনিয়নের কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, কুমখালী গ্রামের একটি অংশের বাঁধ ইতিমধ্যে ভেঙে গেছে। রিংবাঁধ দিয়ে কোনোরকম পানি আটকে রাখা হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে আরও অন্তত পাঁচটি স্থান। যেকোনো সময় তা ধসে পুরো এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
একবার ওই বাঁধ ভেঙে গেলে গড়াইখালী ইউনিয়নের কমপক্ষে পাঁচটি গ্রামসহ পাশের চাঁদখালী ইউনিয়ন ও কয়রা উপজেলার আমাদী ইউনিয়নের অন্তত ২০টিরও বেশি গ্রাম প্লাবিত হবে।
সম্প্রতি ওই এলাকা ঘুরে দেখা যায়, গড়াইখালীর শান্তা এলাকা থেকে বাঁধটি চলে গেছে গাংরখী বাজারের দিকে। বাঁধের ওপর ইট বিছিয়ে মানুষের চলাচলের রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। রবিউল ইসলামের বাড়ির কাছে বাঁধ ভেঙে মাত্র এক হাতের মতো রয়েছে। অন্যান্য জায়গায়ও বাঁধের ভাঙন প্রায় একই রকম। এখন হেঁটে যাওয়া ছাড়া কোনো যানবাহন নিয়ে ওই রাস্তা দিয়ে চলাচল করা যায় না।
ওই এলাকায় ভাঙন প্রতিরোধে উদ্যোগ নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। জাপানের আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার (জাইকা) অর্থায়নে ৮০০ মিটারের মতো নদী শাসন করে বাঁধটি সংস্কার করা হবে। গত বছরের ডিসেম্বরে কক্সবাজারের ‘উন্নয়ন করপোরেশন’ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বাঁধ মেরামতের কার্যাদেশও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি গত এক বছরে সেখানে কোনো কাজই করেনি। এ কারণে ভাঙন আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে।
উন্নয়ন করপোরেশনের কাজটি বাস্তবায়ন করছে ‘আজাদ করপোরেশন’ নামের অন্য আরেকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। জানতে চাইলে ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক সবুজ খান মুঠোফোনে বলেন, কাজটি শুরু করার আগে সার্ভে করে তাঁরা দেখতে পান, কাজের যে নকশা (ডিজাইন) দেওয়া হয়েছে, বাস্তবতার সঙ্গে তাঁর কোনো মিল নেই। তাই বাস্তবতা অনুযায়ী ডিজাইন রিভাইস (পুনর্নকশাকরণ) করার আবেদন করা হয়েছে।
গত মার্চে করা ওই আবেদন অনুযায়ী রিভাইস ডিজাইন হাতে পাওয়া যায়নি। এ কারণে কাজ বন্ধ রয়েছে। তিনি বলেন, হয়তো আগামী মাসে নতুন ডিজাইনটি হাতে পাওয়া যাবে। এরপর বাঁধ সংস্কারে কাজ শুরু করা হবে।
খুলনা পাউবো-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, বেশ বড় ও খরস্রোতা হওয়ায় শিবসা নদীর বাঁধ বিভিন্ন এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কুমখালী এলাকা। ওই এলাকার ভাঙন প্রতিরোধে কাজ শুরু করছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তবে নকশায় জটিলতা আছে, এমন অভিযোগ তুলে কাজ বন্ধ করে রেখেছে ঠিকাদার। ইতিমধ্যে ঠিকাদারকে বেশ কয়েকবার চিঠি দিয়ে কাজ শুরু করার কথা বলা হয়েছে।