শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতি বেশ কম

চাকরি, গ্রামের বাড়িতে অবস্থান, কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়াসহ নানা কারণে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে উপস্থিত হচ্ছেন না।

যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজ

৫ জুন সকাল ১০টা ৪০ মিনিট। যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এম এম) কলেজের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শ্রেণিকক্ষ। পাঠদান করছেন ওই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাহেদ হোসেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শ্রেণিকক্ষে ৯ শিক্ষার্থীর বেশি উপস্থিত হননি। অথচ এই বর্ষে ৭৪ শিক্ষার্থীর নাম রয়েছে কলেজের উপস্থিতির খাতায়। 

কেবল ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষেই নয়, এম এম কলেজের ১৯টি বিভাগের প্রায় সব বর্ষের শ্রেণিকক্ষের উপস্থিতি কমবেশি চিত্র এমনই। প্রথম বর্ষে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি একটু বেশি থাকলেও দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের পাঠদান কক্ষে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি একদমই থাকে না। এমনকি শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কম থাকায় দুপুরের দিকে প্রায় সব বিভাগে পাঠদানই বন্ধ থাকে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কিছু বিভাগের শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষমুখী করতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন। ইতিহাস বিভাগের শিক্ষকেরা নিজেদের পকেটের টাকায় চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধিক উপস্থিতি থাকা পাঁচ শিক্ষার্থীকে পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা করেছেন।

ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাহজাহান কবীর বলেন, ‘শ্রেণিকক্ষে চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীর উপস্থিতি খুব কম থাকে। উপস্থিতি বাড়াতে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে চলতি বছর থেকে পাঁচ শিক্ষার্থীকে বিশেষ পুরস্কৃত করা হবে। ওই পাঁচ শিক্ষার্থীর তালিকা ইতিমধ্যে প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে তাতেও আশানুরূপ শিক্ষার্থী পাওয়া যাচ্ছে না।’

■ ছাত্ররাজনীতির প্রভাবে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণের বিষয়ে কলেজ প্রশাসন কঠোর অবস্থান নিতে পারে না। 

■ এই বিদ্যাপীঠে ৭২টি শ্রেণিকক্ষ প্রয়োজন। সেখানে রয়েছে ৫২টি।

শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সদ্য চতুর্থ বর্ষে ভর্তি হওয়া একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমাদের বন্ধুদের মধ্যে অনেকে খণ্ডকালীন চাকরি করে। ক্লাসের সময় তারা চাকরিতে থাকে। তা ছাড়া অনেকে গ্রামের বাড়িতে থেকে চাকরির প্রস্তুতির জন্য লেখাপড়া করে। মাঝেমধ্যে তারা কলেজ ক্যাম্পাসে আসে। পরীক্ষার সময়ে ফরম পূরণ করে পরীক্ষা দিয়ে যায়। ক্লাসে বসার বিষয়ে আমার সহপাঠী বন্ধুরা ততটা আগ্রহী না।’

৫ জুন কলেজের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শ্রেণিকক্ষে গিয়ে দেখা যায়, ছেলেমেয়ে মিলিয়ে মাত্র ৯ জন শিক্ষার্থী নিয়ে বিভাগীয় প্রধান সহকারী অধ্যাপক শাহেদ হোসেন পাঠদান করছেন। পাঠদান শেষে বিভাগের শিক্ষকদের কক্ষে বসে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম হওয়াসহ বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কথা বললেন তিনি।

সহকারী অধ্যাপক শাহেদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস (পাঠ্যক্রম) অনুযায়ী শিক্ষার্থীর পরীক্ষায় অংশগ্রহণের যোগ্যতা হিসেবে মোট ক্লাসের ৭৫ শতাংশ উপস্থিতি থাকতে হবে। বিশেষ ক্ষেত্রে অধ্যক্ষ বিভাগীয় প্রধানের সুপারিশের ভিত্তিতে উপস্থিতি ৭৫ শতাংশের কম এবং ৬০ শতাংশ বা তার বেশি থাকলে বিবেচনার জন্য সুপারিশ করতে পারবেন। কিন্তু শ্রেণিকক্ষে উপস্থিতির এই নিয়ম যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় না। যে কারণে শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে আসার তেমন কোনো তাগিদ থাকে না।’

কলেজের শিক্ষকেরা বলেন, ছাত্ররাজনীতির প্রভাবে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণের বিষয়ে কলেজ প্রশাসন কঠোর অবস্থান নিতে পারে না। এটা অনুসরণ করলে বর্তমান শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১০ শতাংশের বেশি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের সুযোগ পাবেন না। ফলে শিক্ষার্থীদের অবশ্যই শ্রেণিকক্ষে আসতে হবে।

শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি না, জানতে চাইলে কলেজের অধ্যক্ষ মর্জিনা আক্তার বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে আনার জন্য ১৯টি বিভাগে নিয়মিত সেমিনার অনুষ্ঠিত হচ্ছে। যেখানে শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে। তা ছাড়া সহশিক্ষা কার্যক্রম যেমন প্রতি মাসে কুইজ প্রতিযোগিতা, বিতর্ক অনুশীলন, ভাষা শিখন ক্লাবের কার্যক্রম রয়েছে।’

শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে করোনা পরিস্থিতিকে দায়ী করে অধ্যক্ষ মর্জিনা আক্তার বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতিতে তখন শহর ছেড়ে সব শিক্ষার্থী বাড়িতে চলে যায়। এখনো শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগ বাড়িতেই রয়ে গেছে। আর্থিক কারণে তাদের অনেকে শহরের ছাত্রাবাসে থাকতে পারছে না। যে কারণে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের আগের মতো পাওয়া যাচ্ছে না। তারপরও আমরা শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি বাড়ানোর জন্য নানা ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।’

শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষসংকট

এম এম কলেজের অপর একটি বড় সমস্যা বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষক ও শ্রেণিকক্ষসংকট। মার্কেটিং বিভাগে শিক্ষকের দুটি পদের বিপরীতে তিনজন রয়েছেন। এর মধ্যে একজন প্রভাষক প্রশিক্ষণে রয়েছেন। দুজনে পাঠদান চালিয়ে নিচ্ছেন। ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগেও শিক্ষকের দুটি পদের বিপরীতে দুজন শিক্ষকই রয়েছেন। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ বছর একজন শিক্ষক দিয়ে এই বিভাগের পাঠদান কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া হয়েছে। অথচ এই দুটি বিভাগের মতো সমপরিমাণ বিষয় ও পাঠদান কার্যক্রম থাকলেও হিসাববিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষকের ১২টি পদের বিপরীতে ১২ জন করে শিক্ষক রয়েছেন। যদিও মার্কেটিং ও ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগে স্নাতকোত্তর কোর্স নেই।

ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের শিক্ষকেরা জানান, বিভাগের চারটি বর্ষ ও উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জন্য মাত্র দুটি কক্ষ রয়েছে। যেখানে প্রয়োজন অন্তত চারটি কক্ষের। শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষকসংকটের কারণে এই বিভাগের অবস্থা বেশি নাজুক। একই অবস্থা মার্কেটিং বিভাগেরও।

কলেজ সূত্রে জানা গেছে, এমএম কলেজে বর্তমানে ১৯টি বিভাগ, উচ্চমাধ্যমিক ও ডিগ্রি (পাস) কোর্স মিলিয়ে ২৫ হাজার শিক্ষার্থী লেখাপড়া
করেন। দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম সেরা এই বিদ্যাপীঠে ৭২টি শ্রেণিকক্ষ প্রয়োজন। সেখানে রয়েছে ৫২টি। অন্তত ২০টি শ্রেণিকক্ষসহ বহুমুখী ব্যবহারের জন্য ১০ তলাবিশিষ্ট একটি একাডেমিক ভবন নির্মাণের দাবি রয়েছে।

গত বছরের ২৫ অক্টোবর শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি যশোর এম এম কলেজ পরিদর্শনে গেলে অধ্যক্ষ মর্জিনা আক্তার এ–সংক্রান্ত একটি চিঠি দেন। ওই চিঠিতে আরও দুটি দাবি রয়েছে। এর মধ্যে একটি আধুনিক গ্রন্থাগার ভবন ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত একটি মিলনায়তন।

চিঠিতে বলা আছে, ২৫ হাজার শিক্ষার্থীর এই কলেজ ক্যাম্পাসে ১০ তলাবিশিষ্ট একটি একাডেমিক ভবন, আধুনিক গ্রন্থাগার ভবন ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধার একটি মিলনায়তন স্থাপিত হলে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পাবে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে সরকারের (এসডিজি) টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়ক হবে।