ছেলে রাসেল শেখকে হারিয়ে আহাজারি করেন তাঁর মা শিল্পী বেগম। শুক্রবার দুপুরে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার দিগনগর ইউনিয়নের ফতেপট্টি গ্রামে
ছেলে রাসেল শেখকে হারিয়ে আহাজারি করেন তাঁর মা শিল্পী বেগম। শুক্রবার দুপুরে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার দিগনগর ইউনিয়নের ফতেপট্টি গ্রামে

‘আমার বাবারে ওরা মাইরে ফেলছে’

তিউনিসিয়ায় ভূমধ্যসাগরে নৌকায় দালালদের নির্যাতনে আট বাংলাদেশি মারা গেছেন। তাঁদের লাশ গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে সৌদিয়া এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসে। নিহত আটজনের মধ্যে পাঁচজনই মাদারীপুরের রাজৈরের বাসিন্দা। বাকি তিনজনের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে।

আজ শুক্রবার দুপুরে মুকসুদপুর উপজেলার দিগনগর ইউনিয়নের ফতেপট্টি গ্রামে নিহত রাসেল শেখের (২৩) লাশের অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায় স্বজনদের। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন মা শিল্পী বেগম। স্মৃতি হাতড়ে কিছুক্ষণ পরপর হাউমাউ করে কান্না করে ওঠেন তিনি। শিল্পী বেগম আহাজারি করে বলেন, ‘আমার বাবার স্বপ্ন ছিল বড় ঘর দিবে, ছোট বোনকে ধুমধাম করে বিয়ে দিয়ে পরে নিজে বিয়ে করবে। আমাগে সবাইরে ভালো রাখবে। আমার বাবার সেই স্বপ্ন পূরণ হইল না। আমার বাবারে ওরা মাইরে ফেলছে।’

শিল্পী বেগম আরও বলেন, দালালদের সঙ্গে কথা ছিল, মাছ ধরার বড় ট্রলার দিয়ে সমুদ্র পার করে দেবেন। কিন্তু তাঁরা ৩০ জনের ধারণক্ষমতার নৌকায় ৫২ জনকে নৌকার খোলে (পাটাতনের নিচে) ঢুকিয়ে মেরে ফেলেছেন। তিনি তাঁর ছেলে হত্যার বিচার চান।

রাসেল শেখের বাবা আবুল কাশেম শেখ বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ। ফরিদপুরের ভাঙ্গা এলাকায় ছোট্ট একটা চায়ের দোকান করে সংসার চালাই। অনেক কষ্ট করে সন্তানদের বড় করেছি। তিন সন্তানের মধ্যে একমাত্র ছেলে রাসেল। আমার কষ্ট লাঘব করতে ইতালিতে যেতে চেয়েছিল সে। ভেবেছিল, ইতালি গিয়ে আমাকে একটু শান্তি দেবে।

রাসেল বাড়ি থেকে যাওয়ার দুই দিন পর আমার মা (রাসেলের দাদি) মারা যান। আর মায়ের কুলখানির দিনে ছেলের মৃত্যু খবর পেলাম। আল্লাহ আমাকে আর কত পরীক্ষা নেবেন।’

আক্ষেপ করে আবুল কাশেম শেখ বলেন, ‘আমার ছেলের মুখটা দেখতে ব্যাকুল হয়ে আছি। কখন আমার মানিকের সোনার মুখখানি দেখব, একটু জড়িয়ে ধরতে পারলে বুকের হাহাকার কম তো কি না। আমার মানিককে যারা এভাবে নির্যাতন করে মেরেছে, তাদের বিচার চাই।’

ভূমধ্যসাগরে মারা যাওয়া আটজন হলেন গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার বড়দিয়া গ্রামের দাদন শেখের ছেলে রিফাত শেখ (২৩), দিগনগর ইউনিয়নের ফতেপট্টি গ্রামের মো. রাসেল (২৩) ও গয়লাকান্দি গ্রামের পান্নু শেখের ছেলে ইমরুল কায়েস আপন (২২), মাদারীপুরের রাজৈরের কোদালিয়া গ্রামের মিজানুর রহমান কাজীর ছেলে সজীব কাজী (১৯), পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামের ইউসুফ আলী শেখের ছেলে মামুন শেখ (২২), সেনদিয়ার গ্রামের সুনীল বৈরাগীর ছেলে সজল বৈরাগী (২২), উত্তর পাড়া গ্রামের পরিতোষ বিশ্বাসের ছেলে নয়ন বিশ্বাস (২৪) ও কেশরদিয়া গ্রামের কাওসার (২২)।

নিহত রাসেলের মামা মো. কবীর শেখ বলেন, ‘রাসেল চেয়েছিল পরিবারে সচ্ছলতা ফেরাতে। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল। রাসেল লাশ হয়ে এভাবে দেশে আসবে, সেটা কখনো আশা করিনি আমরা।’ তিনি আরও বলেন, ‘দিগনগর ইউনিয়নের কানুরিয়া গ্রামের সুমন বলেছিলেন, “১৩ লাখ টাকা দিলে রাসেলকে আমরা ইতালি পৌঁছে দেব।” তাঁরা নেওয়ার কয়েক দিন পর তাঁকে শারীরিক নির্যাতন করেছেন, তিন দিন খেতে দেননি। নৌকার পাটাতনের নিচে লুকিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁদের মৃত্যু হয়। আমরা দালালদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির দাবি করছি। যাতে আর কোনো মায়ের কোল খালি না হয়।’

স্বজন, পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত ১৪ জানুয়ারি মাদারীপুরের রাজৈর ও গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার কয়েক যুবক ইতালির উদ্দেশে বাড়ি থেকে বের হন। প্রথমে তাঁরা দুবাই হয়ে উড়োজাহাজে করে লিবিয়ায় পৌঁছান। পরে ১৪ ফেব্রুয়ারি লিবিয়া থেকে দালালদের মাধ্যমে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ইতালির উদ্দেশে রওনা হন তাঁরা। মাঝপথে তিউনিসিয়ায় ভূমধ্যসাগরে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে যাওয়া পথে তাঁদের নির্যাতন করা হয়। এতে রাজৈরের কোদালিয়ার সজীব কাজী, পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামে মামুন শেখ, সেনদিয়ার সজল বৈরাগী, কদমবাড়ির নয়ন বিশ্বাস, কেশরদিয়া গ্রামের কাওসার, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের রিফাদ, রাসেল ও আপনের মৃত্যু হয়। এ ছাড়া এক পাকিস্তানি নাগরিকও মারা যান। খবর পেয়ে কয়েকজনকে জীবিত উদ্ধার করে স্থানীয় কোস্টগার্ড।

নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা গতকাল ঢাকার বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, ৩০ জন যেতে পারবেন, এমন একটি ছোট নৌকায় ৫২ জনকে নিয়েছিলেন দালালেরা। যে আটজন মারা গেছেন, তাঁদের নৌকার পাটাতনের নিচে জোর করে রাখা হয়েছিল। তাঁরা অক্সিজেন-সংকটের কারণে পাটাতন থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু দালালেরা তাঁদের মারধর করে আবার সেখানে পাঠান। এভাবে নির্যাতন ও অক্সিজেন-সংকটের কারণেই তাঁদের মৃত্যু হয়েছে।

মুকসুদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আশরাফুল আলম বলেন, তিউনিসিয়ায় নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো আইনগত সহযোগিতা চাইলে করা হবে। এরই মধ্যে সরকারিভাবে লাশগুলো দেশে এসেছে। তবে এখন পর্যন্ত পরিবার থেকে থানায় কেউ অভিযোগের করেননি। অভিযোগ পেলে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।