মামলা
মামলা

সাভার ও ধামরাইয়ে আরও চারটি হত্যা মামলা

৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় পাঁচজনের মৃত্যুর ঘটনায় গতকাল বুধবার ঢাকার সাভার উপজেলার আশুলিয়া থানায় ও ধামরাই থানায় পৃথক চারটি মামলা হয়েছে।

আশুলিয়া থানায় মো. লেবু (৪০) নামের এক ব্যক্তি নিহত হওয়ার ঘটনায় তাঁর স্ত্রী সেলিনা বেগম ১৫ জনের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা করেন। লেবু সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের ধামরাই উত্তরপাড়া এলাকার বাসিন্দা। তিনি পেশায় মাংস বিক্রেতা ছিলেন। স্ত্রীকে নিয়ে তিনি আশুলিয়ার বাইপাইলের দেওয়ানটেক এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন।

ধামরাই থানায় আফিকুল ইসলাম (১৮) নিহত হওয়ার ঘটনায় ৮২ জনের নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা করেন নিহত ব্যক্তির নানা আজীম উদ্দিন। আফিকুল মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থানার দহগ্রামের সফিকুল ইসলামের ছেলে। মৃত্যুর আগে পরিবারের সবার সঙ্গে তিনি ধামরাই কায়েতপাড়ায় থেকে সাভার ক্যান্টনমেন্ট কলেজে পড়াশোনা করতেন।

আশুলিয়ায় পুলিশের তিন সদস্যকে হত্যার ঘটনায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে পৃথক আরও দুটি হত্যা মামলা হয়েছে। একটি মামলার বাদী নিহত সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. সোহেল রানার স্ত্রী রেশমা পারভীন। এ মামলায় অজ্ঞাতনামা ১০০ থেকে ১৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। সোহেল নওগাঁ সদর থানার কীর্তিপুর এলাকার মো. হাবিবুর রহমানের ছেলে। তিনি ঢাকা জেলার ডিএসবি জোনের আশুলিয়া জোনে কর্মরত ছিলেন।

অপর মামলার বাদী পুলিশ সদস্য রফিকুল ইসলামের স্ত্রী রাব্বি আক্তার। এ মামলায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়েছে। রফিকুল আশুলিয়ার কোনাপাড়া এলাকার আবুল হোসেনের ছেলে। তিনি পুলিশ বাহিনীর স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) মালিবাগে কর্মরত ছিলেন। এ ছাড়া নিহত এএসআই রাজু আহমেদ আশুলিয়া থানায় কর্মরত ছিলেন।

সেলিনা বেগমের করা মামলায় মো. তন্ময় ইসলাম, মো. আবদুল হাকিম, মো. মঞ্জুরুল, নুরুল ইসলাম, মাসুদ রানা, উমর ফারুক, মো. বাপ্পি, রওশন মিয়া, মো. রাব্বি, আমিনুল, বাদল শেখ, আবদুল বারেক, বাবুল শেখ, উত্তম কুমার সরকারসহ অজ্ঞাত আরও ৩০০ থেকে ৪০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিরা সবাই আশুলিয়া থানার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ৫ আগস্ট বেলা আড়াইটার দিকে লেবু দেওয়ানটেকের ভাড়া বাসা থেকে বাইপাইল কাঁচাবাজারে বাজার করতে যান। বেলা তিনটার তাঁর স্ত্রী সেলিনা বেগম জানতে পারেন তাঁর স্বামী বাইপাইল মোড়ের বিসমিল্লাহ হোটেলের সামনে গুরুতর আহত অবস্থায় সড়কে পড়ে আছেন। পরে তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে স্বামীকে খোঁজাখুঁজি করে তাঁকে না পেয়ে জানতে পারেন আহত অবস্থায় তাঁকে আশুলিয়ার গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। হাসপাতালে গিয়ে স্বামীকে মৃত অবস্থায় পান তিনি।

পুলিশ হত্যায় দুই মামলা

রেশমা পারভীনের করা মামলার এজাহারে বলা হয়, ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে অজ্ঞাত একদল দুষ্কৃতকারী আশুলিয়া থানা ঘেরাওয়ের চেষ্টা করে। এএসআই সোহেল সে সময় বাইপাইল মোড় এলাকায় অবস্থান করছিলেন। পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় তিনি নিজের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে পার্শ্ববর্তী ধামসোনা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডে আফসার মণ্ডলের বাড়িতে নিজের ভাড়া বাসায় চলে যান। বিকেল চারটার দিকে নিরাপত্তার জন্য থানার এএসআই রাজু আহমেদ, কনস্টেবল নাজমুল হক ও কনস্টেবল আতোয়ার হোসেনও ওই একই বাসায় আশ্রয় নেন। এদিকে দুষ্কৃতকারী ব্যক্তিরা থানায় তাণ্ডবের পর তারা আশপাশে পুলিশ সদস্যদের অবস্থান খুঁজতে থাকে। বিকেল ৫টা ২০ মিনিটের দিকে ১০০ থেকে ১৫০ দুষ্কৃতকারী ওই ভাড়া বাসায় হামলা চালায়। তারা বাসার ভেতরে ঢুকে বাসায় অবস্থানকারী পুলিশ সদস্যদের কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। এ সময় দুষ্কৃতকারী ব্যক্তিরা এএসআই সোহেল মারা গেছে ভেবে তাঁর লাশ টেনে বাসার নিচে নামিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে কনস্টেবল নাজমুল ও কনস্টেবল আতোয়ার সেখান থেকে কৌশলে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। আর এএসআই রাজু আহমেদের লাশ বাসায় পড়ে থাকে।

এজাহারে আরও বলা হয়, সন্ধ্যা ৬টা ১৫ মিনিটের দিকে দুষ্কৃতকারী ব্যক্তিরা আবার ঘটনাস্থলে এসে এএসআই সোহেলের লাশ পুড়িয়ে দেয় ও এএসআই রাজু আহমেদের লাশ বের করে নিয়ে থানার পাশে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের পদচারী–সেতুতে ঝুলিয়ে রাখে। এক দিন পর পরিবারের সদস্যরা সোহেলের মৃত্যুর খবর জানতে পারেন।

রাব্বি আক্তারের করা মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ৫ আগস্ট বিকেল চারটার পর থেকে রফিকুলের কোনো খোঁজ পাচ্ছিলেন না তাঁর পরিবারের সদস্যরা। পরদিন তাঁরা জানতে পারেন আশুলিয়া থানা এলাকায় পদচারী-সেতুর সঙ্গে দুজন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে একজন দেখতে রফিকুলের মতো। পরে পরিবারের সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে রফিকুলের লাশ শনাক্ত করেন।

এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, রফিকুল ৫ আগস্ট বিকেলে থেকে ৬ আগস্ট সকালের যেকোনো একসময় ওই পদচারী-সেতুর কাছে পৌঁছালে অজ্ঞাতনামা উত্তেজিত জনতা রফিকুলের মুঠোফোন ও মানিব্যাগ চেক করে পুলিশের পরিচয়পত্র পেয়ে তাঁকে এলোপাতাড়ি মারধর করে  তাঁদের লাশ পদচারী-সেতুতে ঝুলিয়ে রাখে।

আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ এফ এম সায়েদ বলেন, গতকাল আশুলিয়া থানায় ৫ আগস্টের ঘটনায় পৃথকভাবে মোট তিনটি হত্যা মামলা হয়েছে।

ধামরাইয়ে মামলা

আজীম উদ্দিনের করা মামলায় ঢাকা-২০ আসনের (ধামরাই) সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য বেনজির আহমদ, সাবেক সংসদ সদস্য এম এ মালেক, ধামরাই পৌরসভার সাবেক মেয়র গোলাম কবির মোল্লা, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাদ্দেস হোসেন, সাবেক সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী আহম্মদ আল জামান, মো. এনামুল হক, বাইশাকান্দা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মিজান, বালিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আহম্মদ হোসেন, ধামরাই উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ, সানোড়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান খালেদ মাসুদ খান, মো. আরিফ হোসেন, ধামরাই পৌরসভার সাবেক কমিশনার তবারক হোসেন, সাবেক কমিশনার সাহেব আলী, মো. শিপলু, মাসুম খান, সাখাওয়াত হোসেন, হিমায়েত কবির, শহিদুল্লাহ, আবু সাইদ, আমিনুর রহমান, সিরাজুল ইসলাম, গাংগুটিয়া ইউপির চেয়ারম্যান আবদুল কাদের মোল্লা, আমজাদ মোল্লা, সুমন আলী, দীপুসহ নামীয় ৮২ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া মামলায় অজ্ঞাত ৮০ থেকে ৯০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

ধামরাই থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মোমেনুল ইসলাম মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এ মামলার এজাহারে বলা হয়, ৫ আগস্ট সকালে ধামরাই হার্ডিঞ্জ উচ্চবিদ্যালয়ের সামনে আন্দোলন করছিলেন ৫০০ থেকে ৭০০ শিক্ষার্থী। এ সময় ১ থেকে ২০ নম্বর আসামিদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী অঙ্গসংগঠনের নেতা–কর্মীরা তাঁদের হাতে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশি অস্ত্র দিয়ে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেন ও যাকে পান তাঁকেই মারধর ও গুলি করতে থাকেন। এ সময় আফিকুল মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। স্থানীয় লোকজন তাঁকে উদ্ধার করে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। ৮ আগস্ট সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়।