ভোক্তা পর্যায়ে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম একলাফে ২৬৬ টাকা বাড়লেও বরিশালের খুচরা বাজারে তা ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা পর্যন্ত বেশি রাখা হচ্ছে। এই দাম দিয়েও গ্যাস পাচ্ছেন না নগরবাসী। ১০ দোকান ঘুরে বেশি দাম দিয়ে গ্যাস কিনতে হচ্ছে। জ্বালানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এর চাপ পড়ছে সংসারে। এর ফলে ক্ষুব্ধ হচ্ছেন ক্রেতারা।
অনেক ক্রেতা অভিযোগ করেছেন, বাজারে দাম বাড়ার আভাস পেয়ে ব্যবসায়ীরা গ্যাস মজুত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অতিরিক্ত মুনাফা করছেন। বাজার তদারকি না থাকায় এর মাশুল দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
আজ শুক্রবার সকাল থেকে বরিশাল নগরের বিভিন্ন বাজার ঘুরে ক্রেতাদের ক্ষোভ আর অভিযোগ শোনা গেছে। আমির কুটির এলাকার বাসিন্দা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নাসির উদ্দীন জানান, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে তাঁর ছয় সদস্যের সংসার চালাতে এমনিতেই হিমশিম খেতে হচ্ছিল। এর মধ্যে আজ সকালে গ্যাস কিনতে গিয়ে দাম শুনে তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ে। তিন দোকান ঘুরে দাম যাচাই করে দেখেছেন ১ হাজার ৬০০ টাকার নিচে কোনো গ্যাস নেই। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘অ্যার চাইতে সরকার মোগো মইর্যা যাইতে কইতে পারে না?’
নগরের ফকিরবাড়ি থেকে গ্যাস কিনতে বটতলা বাজারে এসেছেন গৃহবধূ ফাতিমা আক্তার। বাসার আশপাশের দোকানগুলোতে গ্যাস না পেয়ে রিকশা নিয়ে এত দূর আসতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু দাম একেক দোকানে, একেক রকম। কোথাও ১ হাজার ৬০০ টাকা আবার কোথাও তার চেয়ে বেশি। ফাতিমা আক্তার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘১৫ দিনের ব্যবধানে গ্যাসের দাম ৩০০ টাকা বেড়েছে। আমাদের সামর্থ্য ফুরিয়ে আসছে। সব জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় ছোট বাচ্চাদের খাবার কমিয়ে দিয়েছি, আগের বাসা ছেড়ে কম ভাড়ার বাসায় উঠেছি। জানি না, কত দিন আর সইতে পারব। বাচ্চাদের পাতে সপ্তাহে দুই দিনও মাছ, মাংস দিতে পারছি না।’
বটতলা বাজারের আকন স্টোর, আলম স্টোর, জামান স্টোর—তিনটি দোকান ঘুরে জানা যায়, সব কোম্পানির গ্যাসের দামই ১ হাজার ৬০০ টাকা। আকন স্টোরের মালিক মাহতাব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সিলিন্ডারপ্রতি ৫০ টাকা লাভে বিক্রি করি। তা–ও চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাই না। ১ হাজার ৫৫০ টাকায় পাইকারি কিনি, ১ হাজার ৬০০ টাকায়ই বেচি। পাইকারি বাজারে বাড়ালে আমাদের তো কিছু করার নেই।’
নগরের বাংলা বাজারে গিয়ে কয়েকটি দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এখানে কোম্পানিভেদে নানা দামে গ্যাস বিক্রি হচ্ছে। আপন স্টোরে লাফস গ্যাসের সিলিন্ডার ১ হাজার ৫৮০ টাকায় বিক্রি হলেও অন্য সব কোম্পানির সিলিন্ডার ১ হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে অন্য সব দোকানে ১ হাজার ৬০০ টাকার নিচে কোনো গ্যাস নেই।
তোতা এন্টারপ্রাইজের মালিক মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমরা ১০০ সিলিন্ডার চাইলে ডিলাররা দেন ২০টা। বর্ধিত দাম গুনেও চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাচ্ছি না। ক্রেতারা আমাদের দোষে, প্রতিদিনই বচসা হয়। আমরা নিরুপায়।’
পাশে আরেকটি দোকানে গিয়ে দেখা যায়, সারিবদ্ধ সিলিন্ডার। দাম জিজ্ঞাসা করলে দোকানি কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে বলেন, ‘গ্যাস বেচি না।’ এগুলো কী, জানতে চাইলে তিনি কাউন্টার থেকে বিরক্তি নিয়ে বের হয়ে একটি সিলিন্ডার হাতে নিয়ে বলেন, ‘দ্যাহেন এইগুলা সব খালি।’
তারিকুল নামের এই তরুণ ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমার পুঁজি কম, তাই দাম বাড়নে গ্যাস আনতে পারি না। এত্তো দাম দিয়া গ্যাস আইন্না ক্রেতাগো লগে ফাও ঝগড়া করন লাগে। হ্যার চাইতে বেচনই বাদ দিছি।’ এই ব্যবসায়ীর কণ্ঠে ক্ষোভের ঝাঁজ। বললেন, ‘সরকার একদফা বাড়ায়, আবার ডিলাররা বাড়ায় আরেক দফা। খুচরা বাজারে আওনের পর বাড়ে আরেক দফা। সব নৈরাজ্য, এইগুলা দ্যাহনের কেউ নাই।’
লাফস গ্যাস বাংলাদেশের বরিশালের পরিবেশক রাফিউল আলম খান বলেন, ‘আমরা অসহায়। কোম্পানি বেশি দামে বিক্রি করছে। চাইলেও কিছু করার নেই। কোম্পানি দাম কমালে আমরাও কমাব। এখানে আমাদের কোনো হাত নেই।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বরিশালের সাধারণ সম্পাদক রনজিৎ দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, এখন গ্রাম-শহর সব জায়গায় মানুষ রান্নায় গ্যাসনির্ভর হয়ে পড়েছেন। দাম অসহনীয় হওয়ায় মানুষের সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছে। এতে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধছে। সরকারকে এটা বিবেচনায় নিয়ে অচিরেই দাম সহনীয় করতে উদ্যোগ নিতে হবে। বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক করতে হবে।
পরিবেশকেরা অতিরিক্ত দাম দিয়ে কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে গ্যাস কিনছে। এ জন্য ভোক্তা পর্যায়ে দামে প্রভাব পড়ছে বলে মনে করেন বরিশাল জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক সুমী রানী মিত্র। আজ দুপুরে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বাজার তদারক করে দেখেছি, গ্যাসের অধিক দামের বিষয়টি স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কারসাজি নয়। কোম্পানিকে অতিরিক্ত দাম দিয়ে স্থানীয় ডিলাররা গ্যাস কিনছেন। তারপরও বাজার সহনীয় রাখতে আগামী সোমবার আমরা গ্যাস ব্যবসায়ীদের নিয়ে সভা ডেকেছি। তাঁদের কথা শুনে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’